টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামে বিয়ের ৩৪ দিনের মাথায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুর নাহারের (১৪) মৃত্যু নিয়ে অনেকেই লিখছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রবাসফেরত ৩৫ বছর বয়সী রাজিব খানের সঙ্গে। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় শারীরিক সম্পর্কের কারণে মেয়েটির রক্তক্ষরণ হয়। যার পরিণতিতে সে মারা যায়। একে কি হত্যাকাণ্ড বলা যাবে?
ঘটনাটিতে ক্ষুব্ধ হলেও আমি বিস্মিত নই। কাজের সুবাদে লালমনিরহাটের চর থেকে খুলনার বস্তি পর্যন্ত বাংলাদেশের অনেক কিশোরীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমার। জেনেছি বাল্যবিবাহ নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে দিনযাপন এবং পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের সংগ্রাম। তাদের অনেক সহপাঠীর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে পরিবার। তাই তারাও জানেনা কখন তারা স্কুল থেকে ঝরে পড়বে। নুর নাহার যেমন জানতেন না, হঠাৎ করেই তার জীবন থেমে যাবে। বাল্যবিবাহ যে শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন এবং যৌন নির্যাতন, তা এই ঘটনা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের হার যে বিব্রতকরভাবে বেশি, তা কি আমরা জানি না?
৭ অক্টোবর ২০২০ ইউনিসেফ প্রকাশ করেছে ‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ: এ প্রোফাইল অফ প্রগ্রেস ইন বাংলাদেশ’। এই রিপোর্ট জানাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক এবং বিশ্বে সর্বোচ্চ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে দেশটি। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৯০ শতাংশের বেশি ছিল এবং এখনো এটি যে খুব কমেছে, তা নয়। বর্তমানে ২০-২৪ বছর বয়সী ৫১ শতাংশ নারীই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন।
২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ রোধ করার উদ্দেশ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) নির্ধারণ করা হয়েছে। বাল্যবিবাহ একটি মেয়েশিশুর অকালে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ার কারণ। বিয়ের পর কিশোরীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। মা হওয়ার সময়েও একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় তারা অধিক ঝুঁকিতে থাকে। বাল্যবিবাহ বন্ধ না হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যও অর্জন করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বেড়ে ওঠা মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। শিক্ষার সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যারা অন্তত ১০ বছর স্কুলে যেতে সক্ষম হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার কিছুটা হলেও কম। যারা ১২ বছর স্কুলে যেতে পেরেছে, তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৫০ ভাগ কমে এসেছে।
দারিদ্র্য, কিশোরীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাসহ বাল্যবিবাহের অনেক কারণ আছে। এর পাশাপাশি খুব গুরুত্বপূর্ণ নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনো মনে করে যে মেয়ে ও নারীরা পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেবেন এবং সন্তানের জন্ম দেবেন। সেটাই তাঁদের প্রধান দায়িত্ব। তাঁদের পড়াশোনা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে গৌণ করে দেখা হয়। যার ফলে বাল্যবিবাহ এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
কোভিড-১৯ নারী–পুরুষ, ছেলে–মেয়েদের জীবনযাত্রায় ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯–এর সময় পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। শিশুরা যৌন নির্যাতন, পাচার, শিশুশ্রম ইত্যাদির ঝুঁকির মধ্যে আছে। স্কুল বন্ধ থাকা এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ার কারণে পরিবারগুলোতে বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিও বেড়ে গিয়েছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কোভিড-১৯–এর সময় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে। ঘরে থাকার কারণে গৃহস্থালি কাজে মেয়েরা অধিক সময় ব্যয় করছে। পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব এবং পারিবারিক আয় কমে যাওয়ার কারণে অনেক কিশোরীই হয়তো আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না। ইবোলা–সংকটের পর পশ্চিম আফ্রিকাতে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন–২০১৭–এ বিয়ের বয়সসংক্রান্ত বিশেষ বিধান নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে; সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে যে আইন আছে, তারও যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি যথাযথ জন্মনিবন্ধন ও বিবাহনিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উচিত নিরাপদভাবে স্কুলগুলো পুনরায় খোলার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া। কেননা যত বেশি সময় ধরে মেয়েরা ঘরে অবস্থান করবে, তত বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকবে তারা।
মেয়ে শিশুদের পরিবারগুলোর আয়ের ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কিশোরীদের জীবনে পরিবারের যত্নের দায়িত্বের বোঝা কমিয়ে আনায় বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তা মেয়েদের স্কুলে ফিরে আসতে বাধা না দেয়।
অনেক মা-বাবাই সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–আন্দোলন হচ্ছে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি আমাদের এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে মেয়েরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারবে এবং নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে। যে সমাজে নারীদের সমানাধিকার আছে, সেই সমাজেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা কি আন্তর্জাতিকভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে এবং জাতীয় পর্যায়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলে আন্তরিক? যদি তাই হয়, তবে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিগত দশকের তুলনায় অগ্রগতি কমপক্ষে ৮ গুণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১৭ গুণ বেশি হতে হবে।
বাল্যবিবাহ নির্মূলে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, কোভিড-১৯–এর কারণে তা পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই বাধা দূরীকরণে আমাদের সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, মা-বাবা, মিডিয়াসহ সমাজের সবাইকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলন, যেখানে অন্যদের পাশাপাশি মেয়েশিশুরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। অন্যথায় বিয়ের পর রক্তক্ষরণে নুর নাহারদের মৃত্য ঘটতেই থাকবে এবং আমরা পত্রিকায় লিখে অথবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে বলে মনে করব। আমরা কি তেমন সমাজ চাই—যেখানে কিশোরীরা এভাবে মারা যায়? সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
লায়লা খন্দকার শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ