চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠছে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর দৃশ্য, যেখানে বালক রাজার রাজত্বে জাতীয় সংগীত ‘হরিদাসের বুলবুল ভাজা/ টাটকা তাজা, খেতে মজা...।’ গাওয়া হচ্ছে। যেখানে পৃথ্বীরাজ নামের বালক তার স্বপ্নে রাজা সেজে দিন কাটায় হেসেখেলে। তার সেই কল্পরাজ্যের রাজদরবার ভর্তি ছিল মোসাহেবে, যেখানে সংকট উপস্থিত হলেই আদেশ আসে ‘গর্দান নেওয়ার’। সেখানে পৃথ্বীরাজ চরিত্রটি স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসেও অবশ্য একই রকম উচ্ছল থাকে। কিন্তু এই এখন যার কারণে পৃথ্বীরাজকে মনে পড়ল আবার, সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। বরং তিনি ‘রাজ্যপাট’ হারিয়েও বারবার বলছেন, ‘সব জালিয়াত; জনগণ আমাকেই চায়। এ রাজ্য আমার।’
সফল বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা তরুণ মজুমদার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর নামচরিত্র পৃথ্বীরাজ জানত, তার রাজা হওয়াটা স্বপ্নদৃশ্য শুধু। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। তিনি বাস্তবিকই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছিলেন চার বছর আগে। কিন্তু এই প্রেসিডেন্ট হওয়াটাকে তিনি রাজা হওয়া বলেই ঠাওরেছিলেন। ফলে তাঁর আচরণ যতটা জনপ্রতিনিধিসুলভ ছিল, তারচেয়ে ঢের বেশি ছিল রাজাসুলভ। রাজনীতিতে অপরিপক্ব থাকায় বালক রাজার মতোই খামখেয়ালিভাবে দেশ পরিচালনা করেছেন এই আপাদমস্তক ব্যবসায়ী। পৃথ্বীরাজের মতোই যেকোনো সংকটের মুখে তিনি হাজির করেছেন অভ্রান্ত দাওয়াই, ‘ইউ আর ফায়ারড।’ তিনি যেন ওভাল অফিসে নয়, পুরো সময় বসে ছিলেন তাঁর জনপ্রিয় টিভি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’-এর সঞ্চালক ও বিচারকের আসনে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদের প্রথম বছরেই তাঁর উপদেষ্টা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর ৩৫ শতাংশে পরিবর্তন আসে বলে এক হিসাবে জানিয়েছে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন। পরের তিন বছর এ হার ছিল যথাক্রমে ৩১, ১৭ ও ৮ শতাংশ। এদের কাউকে প্রেসিডেন্ট বরখাস্ত করেছেন, কেউ আবার চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করান। এ তালিকায় রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন, এইচ আর ম্যাকমাস্টার ও জন বোল্টনের মতো ব্যক্তি। হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ ও যোগাযোগ পরিচালকের পদটিকে রীতিমতো অনিশ্চিত করে তুলেছিলেন ট্রাম্প। চিফ অব স্টাফ পদে এখন যে মার্ক মেডোস আছেন, তিনি এই পদে আসা চতুর্থ ব্যক্তি। গত চার বছরে মন্ত্রিসভায় ও হোয়াইট হাউসের শীর্ষ পদগুলোকে এতটাই অস্থির করে তুলেছিলেন ট্রাম্প যে একপর্যায়ে লোভনীয় এসব পদে যোগ দেওয়ার মতো আগ্রহী কাউকে খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল।
পৃথ্বীরাজের মতোই তিনি খেলায় মগ্ন ছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার গলফ খেলার তীব্র সমালোচক ট্রাম্প নিজেই অভিষেকের দুই সপ্তাহের মধ্যে গলফ ক্লাব অভিমুখী হন। সে সময় নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছিল, অভিষেকের পর প্রথম ছয় মাসে তিনি ৪০ বারের বেশি গলফ ক্লাবে গেছেন। আর নির্বাচনে বিজয় ঘোষণার সময় ভার্জিনিয়ায় নিজস্ব গলফ ক্লাবে তাঁর গলফ খেলার খবর তো এখন সবার মুখে মুখে। তাঁর টেলিভিশনপ্রীতিও প্রবাদপ্রতিম পর্যায়ের ছিল। ওভাল অফিসে তিনি টিভি দেখে সময় কাটান বলেও খবর চাউর হয়েছিল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু তাঁর সমর্থক হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজই দেখতেন বলে কথা প্রচলিত আছে। দেখবেন নাই-বা কেন? কারণ, তাঁর দৃষ্টিতে বাকি সব সংবাদমাধ্যমই তো ‘ভুয়া খবরের’ প্রচারক।
এই পর্যায়ে একটা গল্প মনে পড়ল। এক তরুণ রাজনৈতিক কর্মী তাঁর জ্যেষ্ঠ এক নেতার কাছে ছুটে গেলেন হন্তদন্ত হয়ে। বড় ভাইয়ের প্রশ্ন, ‘কী হয়েছে?’ তরুণ কর্মী বলছেন, ‘ভাই নেতার নামে মামলা হয়েছে?’ বড় ভাইয়ের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কী মামলা?’ চটপট উত্তর, ‘মিথ্যা মামলা।’ ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন তরুণ কর্মীটির মতোই। শুনে যতই হাসি আসুক না কেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ফেক নিউজ’ শব্দবন্ধের যে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তার প্রভাব ভয়াবহ। ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া, তাঁর বিতর্কিত নানা কথা ও আচরণের কারণে তিনি বারবার মার্কিন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। হতে পেরেছেন যুক্তরাষ্ট্রে এত বছর ধরে গড়ে ওঠা বাক্স্বাধীনতার সংস্কৃতির জন্যই। তারপরও তাঁর এই ‘ফেক নিউজ’ শব্দবন্ধটি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য এতটাই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে বাকি মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি খবরে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্ল্যাক–আউট করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এটা মার্কিন গণমাধ্যমের শক্তির পরিচায়ক। এমন শক্তি খুব কম দেশের গণমাধ্যমেরই আছে।
তবে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমেরও এমন শক্তির প্রকাশ আমরা সম্প্রতি দেখেছি। গত বছরের অক্টোবরে দেশটির প্রথম সারির বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রথম পাতা ফাঁকা রেখে প্রকাশ করে। দেশটিতে হওয়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থী আইনের প্রতিবাদ ছিল এটা। এমন সাহস বহু দেশ দেখাতে পারেনি।
সবচেয়ে বড় কথা, গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে পায় দলে বিশ্বের ঘোষিত ও অঘোষিত একনায়কদের স্তুতি করে এবং নিজেও রাজার ধাঁচে দেশ চালিয়ে তিনি সারা বিশ্বের অগণিত মানুষের যে ক্ষতি করলেন, তার কী হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেখাদেখি গত চার বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন বহু রাষ্ট্রপ্রধানের আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা নিজের বিরুদ্ধের যেকোনো সমালোচনাকেই ‘ভুয়া খবর’ হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির ফেরিওয়ালা দেশটির সর্বোচ্চ আসনে বসা ব্যক্তিই যদি এমন অবস্থান নেন, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো তেমন মজবুত নয়—এমন দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানেরা একটা বড় ছাড় পেয়ে যান। গত চার বছরে বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে এই ছাড়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
অনেকে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। বরং যুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছে। এটা সত্য। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইরানের বিষয়ে কী বলতে হবে? যে শান্তি আলোচনায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন প্রবেশ করেছিল, যা বিশ্বকে একটা আশার আলো দেখাচ্ছিল, তাকে তিনি এক ঝটকায় খারিজ করলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সংকটে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ময়দান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলেন। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, যা বরাবরই ইসরায়েলবান্ধব বলে পরিচিত বিগত কোনো মার্কিন প্রশাসন করার সাহস করেনি। ইয়েমেনের লাখো মানুষের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রাম্প প্রশাসনের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে পায় দলে বিশ্বের ঘোষিত ও অঘোষিত একনায়কদের স্তুতি করে এবং নিজেও রাজার ধাঁচে দেশ চালিয়ে তিনি সারা বিশ্বের অগণিত মানুষের যে ক্ষতি করলেন, তার কী হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি সবচেয়ে কম ব্যয়ে সর্বোচ্চ লাভ করতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানো মানে তো বিনিয়োগ করাও। তিনি এই বিনিয়োগই শুধু করেননি; বাকি সবই করেছেন। যেকোনো দেশে কর্তৃত্ববাদের জন্ম ও টিকে থাকা নির্ভর করে জাতীয়তাবাদের উত্থান ও এর সম্প্রসারণের ওপর। আর জাতীয়তাবাদ বরাবরই প্রতিবেশীদের খারিজ বা নিদেনপক্ষে চাপে রাখার সমীকরণ মেনে সম্প্রসারিত হয়, যেখানে অস্ত্রের জোগান ও মজুত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তুলে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগ কমিয়েছেন শুধু। মুনাফার সমীকরণটি আলাদা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে নেতা নিজ দেশের ক্ষতি করেন বিভাজন ও বর্ণবাদ ছড়ানোর মাধ্যমে, তিনি গোটা বিশ্বের জন্য ইতিবাচক হবেন কী প্রকারে।
যাহোক, আবার স্মরণ করা যাক পুরোনো মন্তব্য, ‘দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট ট্রাম্প’ বইয়ের লেখক মাইকেল ডি’আন্তোনিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন, ‘প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি নিজেকে যেমন দেখেছি, এখনো ঠিক সে রকম। একটুও বদল হয়নি। ধাত ও মেজাজে কোনো ভিন্নতা নেই।’ মাইকেলের মতে, ‘এটি কখনোই একটি মহান গণতান্ত্রিক দেশের নেতার মানসিকতা হতে পারে না। বরং এক বালক রাজার মানসিকতার সঙ্গেই এটি বেশি সাযুজ্যপূর্ণ।’ এ কথা যে কতটা সত্য, তা নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁর আচরণে একেবারে স্পষ্ট। হোয়াইট হাউস ছাড়া তাঁর যেন আর কোথাও যাওয়ার নেই। এমন গোঁ ‘বালক রাজা’ ছাড়া আর কার থাকতে পারে?
ফজলুল কবির: প্রথম আলোর সহসম্পাদক ও লেখক
[email protected]