২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়াতে হবে

আমাদের অর্থনীতির ব্যাপ্তি বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বাজেটের আকার বাড়ছে। কিন্তু আমাদের বাজেট বাস্তবায়নের যে সক্ষমতা তার সঙ্গে এটি মানানসই নয়। কারণ, প্রতিবছরই দেখা যায়, আমাদের বাজেট বাস্তবায়িত হয় না। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের হারও কম, গত বছর তা ছিল ৫২ শতাংশ। বিপুল বাজেটের কারণে আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও বিপুল। কিন্তু সক্ষমতা না থাকায় সেই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব না।

প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। বড় বড় প্রকল্প অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে, যদিও নির্বাচনের বছরে এটি কষ্টসাধ্য কাজ। নির্বাচনের আগে সরকারকে গয়রহভাবে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করতে দেখা যায়। কিন্তু সরকারকে এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের পথে তিনটি বাধা চিহ্নিত করা যায়: ১. সক্ষম জনশক্তির অভাব, ২. দুর্নীতি, ৩. দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা। সক্ষম জনশক্তির অভাবে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। তবে আশার কথা, এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সক্ষম জনশক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কর্মদক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও তহবিলের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু এসব কথা বাজেটে থাকা আর বাস্তবায়ন করা এক কথা নয়। কর্মদক্ষতা বাড়ানোর এই উদ্যোগ এনবিআরের সংস্কারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিতে হবে। আমরা জানি, তারাও রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে তাদের সঙ্গে সমন্বয় রাখা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি আমাদের দেশে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। সরকারের সব প্রকল্পে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনবোধে কঠোর হতে হবে। সরকারের কাজে দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। ছোট-বড় সব প্রকল্পে এটি থাকতে হবে। সব প্রকল্পের একটি মনিটরিং কমিটি থাকবে। তাদের কাজ হবে প্রকল্পের কাজ কতখানি হয়েছে এবং তার জন্য যে টাকা ব্যয় হয়েছে, তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা মনিটর করা। এভাবে যদি প্রতিটি প্রকল্পে আমরা মনিটরিং নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে দুর্নীতির রাশ টানা হয়তো সম্ভব হবে।

এবারের বাজেটের আগে ভ্যাট নিয়ে এত আলোচনা হলো যে মনে হয়, ভ্যাট ছাড়া এ বাজেটে আর কিছু নেই। ভ্যাটের হার নির্ধারণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অনেক টানাপোড়েন চলল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার নিজ অবস্থানেই অটল থাকল। তবে ভ্যাটের জালটা একটু গুটিয়ে নিল। অর্থাৎ অনেক পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট তুলে নেওয়া হলো, যেগুলোর ওপর একসময় ভ্যাট ছিল। কিন্তু এটা কর নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কর নীতিতে অধিকাংশ পণ্যের ওপর অল্প হারে ভ্যাট আরোপের কথা বলা আছে। এতে সরকারও যেমন অধিক রাজস্ব পায়, তেমনি অল্পসংখ্যক ক্রেতার ওপর চাপটা পড়ে না। অর্থাৎ বিস্তৃত ব্যবসায়িক পরিসরে ভ্যাট আরোপ করা উচিত। আমরা সে পথে গেলাম না।

রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে আরেকটি মৌলিক প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। আমাদের রাজস্বে তো এমনিতেই প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের অবদান বেশি। অথচ গণতান্ত্রিক দেশে ঠিক এর উল্টোটা হওয়া উচিত। সরকার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার মেটানোর জন্য আমাদের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপাচ্ছে, অথচ প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে না। ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ হবে না ১২ শতাংশ, তা নিয়ে অনেক তুলকালাম হলো। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক সামর্থ্যবান মানুষেরা যে প্রত্যক্ষ কর দেন না বা যাঁদের যতটুকু দেওয়ার কথা তাঁরা ততটুকু দেন না, এ ব্যাপারটা মনে হয় আমরা মেনে নিয়েছি।

কয়েক দিন আগেই দেখলাম, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ হাজার ৬৭০ জন করদাতা সোয়া দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে বলে রিটার্নে দেখিয়েছেন। দুই কোটি টাকার সম্পদ দেখালে করের ওপর অতিরিক্ত সারচার্জ দিতে হয়। অথচ আমরা খালি চোখেই দেখতে পারি, শুধু ঢাকা শহরেই এই পরিমাণ সম্পদধারী মানুষের সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষ কর ফাঁকি দিচ্ছেন। তাঁদের করের আওতায় আনতে হবে। তা না করে গয়রহভাবে সবার ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।    

ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করা খুবই অযৌক্তিক। এতে আমাদের গ্রাহকেরা দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একদিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অরাজকতার কারণে সুদের হার ক্রমেই কমছে, অন্যদিকে তার ওপর অতিরিক্ত আবগারি শুল্ক আরোপ করা হলো। মানুষ তো খরচ এবং কর দেওয়ার পর যা থাকে, সেটাই সঞ্চয় করে থাকে, ফলে সেই সঞ্চয়ের ওপর করারোপ কাম্য নয়। ওদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও ক্রমেই কমছে, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়। সরকার সহজভাবে বা বিনা বাধায় কর সংগ্রহের চিন্তা করে, সে কারণে আমানতের ওপর কর বসিয়েছে। সরকারকে এই প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে।

সমাজে সমতা বজায় রাখার একটি মাধ্যম হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এতে মানুষের হাতে টাকা যায়, তাঁদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়। পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পের কারণে সরকারি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু সেখানে আর কত মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আরেকটি ব্যাপার, কয়েক বছরে খুব বেশি মানুষ আমাদের দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে না। ফলে দেশের ভেতরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। শুধু বাজেটের আকার বাড়াটাই যথেষ্ট নয়।

আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে আছে। বাজেট বরাদ্দ দিয়ে এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও সরকার দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত (২০১৬-১৭ অর্থবছর বাদে) আট বছরে ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয় থেকে সরকার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দিতে গড়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ দিয়েছে।

সরকারি ব্যাংক থেকে কিছু লোককে টাকা লোপাট করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে তার দায় চাপানো হচ্ছে জনগণের ঘাড়ে। এটা মোটেও কাম্য নয়। অথচ ভারতের সরকারি ব্যাংক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেও সরকারকে উল্টো মূলধন দিচ্ছে। সেই টাকা ভারত সরকার বাজেটে ব্যয় করছে। সরকারি ব্যাংককে এই জায়গা থেকে বের করে আনতে হবে।

বিনিয়োগে স্থবিরতা যেকোনো অর্থনীতির জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্রানুসারে বিনিয়োগ বাড়লেই প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। তবে তার কারণ শুধু রাজনৈতিক নয়। নানা রকম প্রশাসনিক জটিলতার কারণেও ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কিন্তু এবারের বাজেটেও বিনিয়োগ-স্থবিরতা কাটানোর কার্যকর কৌশল নেই। তবে গ্যাস ও তেল সরবরাহের উদ্যোগ আছে, এ খাতে বরাদ্দ আছে। জ্বালানির অভাবে বিনিয়োগ ব্যাহত হয় বলে আমরা জানি। তবে এসব উদ্যোগ সরকারকে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। আরেকটি ব্যাপার, দেশ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে বিনিয়োগের স্থবিরতাও অন্যতম কারণ। তাই এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকার অবকাশ নেই।

আমাদের দেশে তো ইউরোপ ও আমেরিকার মতো সামাজিক নিরাপত্তা নেই। তার জায়গায় আছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী। সে কারণে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। বিশেষ করে সমাজের হতদরিদ্র মানুষের জন্য এটি খুবই দরকারি। তবে এটা যেন তাঁদের হাতে পৌঁছায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এই বেষ্টনীর আওতায় যাঁরা মাসে ৩০ কেজি করে চাল পান, বাজেটে তাঁদের ২০০ টাকা নগদ ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে—যা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। তবে তাঁদের যেন ১০ টাকার হিসাব খুলে এই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তা না হলে এই টাকা তাঁদের হাতে পৌঁছাবে কি না, তার নিশ্চয়তা কী।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।