বাংলাদেশের ব্যাংকিং কতটা গণমুখী

একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে সে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। অভ্যন্তরীণ লেনদেন থেকে শুরু করে বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার আদান–প্রদান, জনগণের সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি এবং তা আমানত হিসেবে সুরক্ষা, গচ্ছিত আমানতের সদ্ব্যবহার তথা ঋণ প্রদান ও আদায়, বিনিয়োগ—এমন প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা রয়েছে। বলা যায় কোন দেশের অর্থনীতি কতটা উন্নত, তা সে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কতটুকু উন্নত, তা কতটা গণমুখী বা সে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার গভীরতা ইত্যাদি পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যায়।  

বাস্তবিক অর্থেই উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর খুবই বেশি মাত্রা নির্ভরশীল। মৌলিক ব্যাংকিংয়ের কথাই ধরা যাক, যেখানে জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি তথা আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার সুরক্ষা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এটাই সত্যি যে মানুষ যা আয় করে তার পুরোটা সে একসঙ্গে একই সময়ে ভোগ করে না। ভবিষ্যৎ সুরক্ষা ও বিনিয়োগের জন্য তা সঞ্চয় হিসেবে গচ্ছিত রাখে। কালের পরিক্রমায় নানা ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও ব্যাংকিং ব্যবস্থাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। মানুষ তাই তার কষ্টার্জিত আয় সুরক্ষার জন্য প্রথমেই ব্যাংকের কথাই মনে করে থাকেন।

অন্যদিকে মানুষ বিনিয়োগের নিমিত্তে অতীতে অনানুষ্ঠানিক নানা উৎস থেকে ধার করলেও কালক্রমে তা সংকুচিত হয়ে এসেছে। অতীতে মানুষ কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের জন্য পরিচিতজনের নিকট থেকে ধারদেনা করতেন। সমাজে অনানুষ্ঠানিক অনেকে যাঁরা মহাজন হিসেবে কথিত, তাঁরাও বিনিয়োগের ঘাটতি পূরণে অর্থায়ন করতেন। কিন্তু আধুনিক সময়ে বিনিয়োগের পরিধি, পরিমাণ ও ধরন সবকিছুই পরিবর্তিত হওয়ার কারণে অনানুষ্ঠানিক অর্থায়ন একেবারেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। বর্তমানে তাই যে কেউই বিনিয়োগের ঘাটতি পূরণে আনুষ্ঠানিক অর্থায়নের উৎস সন্ধান করে থাকেন।

বলা বাহুল্য, আনুষ্ঠানিক অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো অদ্বিতীয়।
অপর দিকে অর্থনীতির প্রসারের কারণে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গেছে। বর্তমানে কোনো একটি দেশ এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কোনো দেশ তার উদ্বৃত্ত পণ্য ও সেবার প্রসার ও বিক্রয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বৈদেশিক বাজারের সংস্থান করে থাকে। অপরাপর ঘাটতি উৎপাদনের দেশগুলোতে সেসব দেশ পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে থাকে। যেসব দেশ পণ্য ও সেবা উৎপাদনে সমর্থ নয়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য তারা বৈদেশিক বাজার থেকে সেসব পণ্য ও সেবা আমদানি করে থাকে। কিন্তু আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের পুরো প্রক্রিয়াতেই আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। বলতে গেলে আধুনিক আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে চাহিদাপত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে পরবর্তী ধাপে মুদ্রার লেনদেন পর্যন্ত সব কাজ ব্যাংকের মাধ্যমেই সমাধা হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার আদান–প্রদানের ক্ষেত্রেও ব্যাংকিং ব্যবস্থাই অগ্রগামী। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আদান–প্রদানে ব্যাংকিং ব্যবস্থাই আস্থার প্রতীক। বিদেশে অবস্থান ও কর্মরত মানুষ তাঁদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের মাধ্যমেই দেশে পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কেউ বিদেশে যেকোনো উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করতে গেলে তাঁকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও সবাই ব্যাংকের নিকটই শরণাপন্ন হয়ে থাকেন।

ওপরে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলো ছাড়াও বর্তমানে মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন নানা কাজে এবং মানুষের উন্নত জীবন মান নিশ্চিতে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। যেমন গৃহস্থালির বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস বিল পরিশোধ, পৌর কর, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি জমাদান ইত্যাদি নানা কাজে ব্যাংক সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার জীবনযাত্রা সহজীকরণে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ট্রান্সফার, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবা খাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থাই অনন্য।

সুতরাং বিস্তারিত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় ব্যাংক মানুষের জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এসব কারণে উন্নত অনেক দেশেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা জীবন ও গণমুখী। সেসব দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার গভীরতাও ব্যাপক। গণমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বলতে কোনো দেশের সমাজ ও জীবন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে সে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, শিল্পভিত্তিক একটি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ওই খাতে জড়িত সবাই যাতে কাম্য ব্যাংকিং সেবা পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করা বোঝায়। অন্যথায় কৃষিপ্রধান সমাজ ব্যবস্থায় কৃষি এবং তার সহায়ক প্রতিটি খাতে জড়িত সবাই যাতে ব্যাংকিং সেবার আওতাভুক্ত হতে পারেন, তা বোঝায়। সে জন্য কোনো দেশের নৌবন্দরে কোনো একটি ব্যাংকের শাখা, তার অবস্থান, সেবার মান ও মাত্রা এবং তার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যবস্থাপনা ওই দেশেরই কোনো একটি গ্রাম্য বাজারে কোনো ব্যাংকের শাখা, অবস্থান, সেবার মান ও মাত্রা এবং তার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যবস্থাপনা ভিন্নতর হওয়াই স্বাভাবিক।

কোনো দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা কতটুকু গণমুখী, তা নির্ধারণে বেশ কিছু মানদণ্ড রয়েছে। তেমনই একটি মানদণ্ড হলো কোনো দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএমের পরিমাণ। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ সালে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের বিপরীতে এটিএম ছিল প্রায় ১৬৬টি। ওই সময়ে জাপানে ছিল ১২৫, পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৭৪ এবং বাংলাদেশে ছিল শূন্য দশমিক ১৩ মাত্র। ২০১৭ সালে এসে এ সংখ্যা ঊর্ধ্বগামী হলেও অন্যান্যের তুলনায় বেশ নিচেই অবস্থান করছে বাংলাদেশের সূচক। যেমন ২০১৭ সালে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে জাপানে এটিএম ছিল ১২৮, ভারতে ২২, পাকিস্তানে ১০ আর বাংলাদেশে প্রায় ৮টি। ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড বা আইএমএফের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে জাপানে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ব্যাংকের শাখা ছিল যেখানে ৩৪টি, সেখানে ভারতে ছিল প্রায় ১৫টি, পাকিস্তানে প্রায় ১০টি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৯টি।

ওপরে উল্লিখিত বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ড বা আইএমএফের যেকোনো পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে বাংলাদেশে গণমানুষের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাতে অংশ ও সেবা গ্রহণ বেশ পিছিয়ে বলেই প্রতীয়মান হয়। যদিও শেষোক্ত পরিসংখ্যানে যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবের পরিসংখ্যান প্রায় ৪১ শতাংশ, কিন্তু ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান বা এনজিও, সমবায় এবং ডাকঘর সঞ্চয় হিসাব বাদ দিলে সংখ্যাটি বেশ কমে আসবে।

গণমুখী ব্যাংকিংয়ের আরেকটি নির্ণায়ক হতে পারে কোনো দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের কত শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক পরিসংখ্যান রয়েছে। বিশ্বব্যাংক কোনো দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার যাদের ব্যাংক, ক্রেডিট ইউনিয়ন বা অন্যান্য যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন সমবায় বা ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানে এমনকি ডাকঘর সঞ্চয়ী ব্যাংকে হিসাব রয়েছে তাদের নিয়ে জরিপ করেছে। বিশ্বব্যাংকের ওই জরিপ বলছে, ২০১৭ সালে জাপানে মোট জনসংখ্যার ১৫ বছরের বেশি এ রকম মানুষের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাব ছিল প্রায় ৯৯ শতাংশের। ওই সময়ে যুক্তরাজ্যে এ পরিসংখ্যান ছিল প্রায় ৯৭ ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯৪ শতাংশ। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাব ছিল ভারতে প্রায় ৭৪ শতাংশের এবং বাংলাদেশে মাত্র ৪১ শতাংশ জনগণের।

একটি গণমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তাই সব শ্রেণি–পেশার মানুষের সার্বিক অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। এ রকম ব্যবস্থায় কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, মহিলা, পুরুষ, ছোট, বড়, কর্মক্ষম, বেকার, ধনী, গরিব সবাই কোনো না কোনোভাবে ব্যাংক এবং ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে থাকতে হয়। বলতে গেলে ব্যাংক এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত না থাকলে তাদের সেবা গ্রহণ ও প্রদানে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
যেমন দুস্থদের জন্য সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে সহায়তা। সে ক্ষেত্রে যদি ওই সহায়তা শুধু ব্যাংকের মাধ্যমেই দেওয়া হয়, তখন মানুষ এমনকি দুস্থরাও ব্যাংকে হিসাব খুলবে এবং তা পরিচালনা করবে। কিন্তু সমাজের এ রকম একটি স্তর, যারা কি না দুস্থ হিসেবে পরিগণিত, তাদের হিসাব পরিচালনার জন্যও যদি ব্যাংক সমাজের অপরাপর গোষ্ঠীর মতোই চার্জ কর্তন করে, তবে তা গণমুখী ব্যাংকিং না হয়ে তা হবে সংকোচনশীল ব্যাংকিংয়ের উদাহরণ। এ রকম বাস্তবতায় মানুষ ব্যাংকমুখী না হয়ে ব্যাংক বিমুখ হবেন।

বুঝতে হবে সমাজের নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ নানা কারণে ব্যাংকে হিসাব খুলে থাকেন। সেখানে মস্ত শিল্পপতি থেকে শুরু করে সমাজের দুস্থরাও থাকতে পারেন, থাকাটাই স্বাভাবিক এবং থাকবেন। ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা আর তা পরিচালনার জন্য তাই সবাই সমান চার্জ দেবেন, না দিলে জরিমানা মাশুল বা হিসাব বন্ধ করে দেবে, তা কোনোভাবেই গণমুখী ব্যাংকিংয়ের উদাহরণ হতে পারে না। এ দায় শুধু কোনো এক বিশেষ প্রকারের ব্যাংকের ওপরও বর্তায় না। যেমন কোনো দেশে নানা মালিকানার ব্যাংক আছে। কথিত রাষ্ট্র মালিকানা থেকে শুরু করে বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানা, বিদেশি মালিকানা ইত্যাদি সব ক্ষেত্র ও প্রকারের সবাইকে গণমুখী ব্যাংকিং বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে। কেউ যদি মনে করেন যে কৃষকদের ব্যাংকিং সেবাদানের জন্য সে দেশের কৃষি ব্যাংকই শুধু দায়বদ্ধ, তবে সেখানে গণমুখী ব্যাংকিং স্থাপন এবং তার টিকে থাকা ও প্রসার হবে সুদূর পরাহত।

ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।