প্রাণীর কোষবিভাজনের প্রক্রিয়ায় ‘ডিএনএ’ কপি করার সময় ছোট ছোট বিচ্যুতি ঘটতে থাকে, যা ‘মিউটেশন’ নামে পরিচিত। এ রকম মিউটেশনের ফলেই নতুন ‘ভেরিয়েন্ট’ জন্ম নেয়। এদের মধ্যে যে কয়টা রূপভেদ সে প্রাণীর বংশবিস্তারে সহায়ক হয়, সেগুলো ‘স্ট্রেইন’ হিসেবে টিকে যায় এবং অন্য সব অনানুকূল ভেরিয়েন্ট বংশবৃদ্ধি করতে না পেরে বিলীন হয়ে যায়। আর এসবের মধ্যে যেটি অতি আনুকূল্য পায়, সেটি ‘ডমিনেন্ট’ হয়ে ওঠে। এ রকমই একটি ‘ডমিনেন্ট স্ট্রেইন’ বি.১. ৬১৭, যাকে ‘ডেলটা ভেরিয়েন্ট’ বা ‘ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট’ বলা হচ্ছে। এ ডেলটা ভেরিয়েন্টের ওপর আরেকটি মিউটেশনের ফলে জন্ম নিয়েছে ‘ডেলটা প্লাস’। প্রাথমিকভাবে করোনা মহামারির জন্য চীনকে দায়ী করা হলেও পরবর্তী কিছু গবেষণায় জার্মানি ও ইতালিতে উহানের আগেই এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সেগুলোও চীন থেকে গিয়েছিল কি না, কিংবা এসবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রেরই–বা কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেগুলো অবশ্য পৃথক বিতর্ক, ভিন্ন রাজনীতি!
অন্যদিকে, করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক নয় বরং কোনো ল্যাবে তৈরি হয়েছে—এমন ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ যদি হালে পানি পায়, তাহলে ‘প্রাণ’ সৃষ্টির প্রচলিত ধ্যানধারণা নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হতে পারে। বস্তুত ভাইরাসের উদ্ভব, প্রসার ও পরিবর্তনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি এমন যে এখানে কোনো পূর্বপরিকল্পনার সুযোগ নেই। অবিরামভাবে চলতে থাকা পর্যায়ক্রমিক ‘মিউটেশন’ পুঞ্জীভূত হয়েই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অভিযোজিত হয়ে নতুন নতুন ‘প্রজাতি’ জন্ম নেয়।
করোনা অতিমারির নির্মমতার মধ্য দিয়ে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাস, তার বংশবিস্তার, মিউটেশন, বিভিন্ন ভেরিয়েন্ট ও স্ট্রেইনের দাপট এবং অদূর ভবিষ্যতে আরেকটি নতুন প্রজাতির ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কার মধ্য দিয়ে মানবজাতি আজ দিন অতিবাহিত করছে। ভাইরাসটি যে রকম জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাতে নিশ্চয়ই কেউ আর দাবি করবেন না যে এ নৃশংসতার পেছনে কারও কোনো হাত রয়েছে! আমরা বরং নিজের চোখেই দেখতে পারছি, যেখানে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, সেখানেই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। যত বিস্তার হচ্ছে, ততই বংশবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে ভাইরাসটি, আর প্রতিটি বংশবিস্তারের সঙ্গেই ঘটছে ‘ডিএনএ কপিইং’ পর্ব। যত বেশি কপি হচ্ছে, তত বেশি করে হচ্ছে ‘র্যানডম মিউটেশন’। এসব মিউটেশনের বেশির ভাগই নিষ্ফলা হলেও কিছু কিছু ভেরিয়েন্ট আরও বেশি সংক্রামক বা বংশবিস্তারে ততোধিক পারঙ্গম হয়ে উদ্ভাবিত হচ্ছে।
প্রতিটি প্রাণীর একমাত্র তাগিদ কেবল বংশবিস্তার করা, তা অন্য প্রাণীর তো বটেই, কখনোবা নিজের দলের অন্য সদস্যদের, এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও। প্রকৃতিতে পুরুষ প্রাণীদের হাতে দুগ্ধপোষ্য শিশু হত্যা ও পানিতে ডুবতে থাকা মাকে সন্তানের শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে যেমন দেখা যায়, তেমনি ‘ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার’ প্রজাতির পুরুষ মাকড়সা মিলন শেষে নারী অঙ্গে তার লিঙ্গ ভেঙে দিয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে, যেখানে তার দেহাবশেষ প্রসূতি মায়ের খাদ্য হিসেবে কাজে লাগছে। বংশবিস্তারের মাধ্যমে টিকে থাকার প্রশ্নে ‘শ্রেয়নীতি’র কোনো স্থান নেই! জীবনের কেবল একটাই মন্ত্র, ‘বংশবিস্তার করো, প্রয়োজনে বদলে যাও, না হয় বিলীন হয়ে যাও’।
মানবজাতি তার নিজস্ব প্রতিরোধক্ষমতা, ওষুধপথ্য ও টিকার সমন্বয়ে ‘সার্স-কোভ-২’-এর বিরুদ্ধে যে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছে, তাতে করোনাভাইরাসকে হয় অভিযোজন করে নতুন রূপে আবির্ভূত হতে হবে, না হয় চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে হবে। ‘সোয়াইন ফ্লু’সহ বহু ভাইরাস পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আবার ‘সার্স-কোভ’ রূপান্তরিত হয়েছে ‘সার্স-কোভ-২’-তে। তবে বিতাড়িত হওয়ার আগে, ভাইরাসটির বংশবিস্তার যত কঠিন হয়ে উঠবে, তত নতুন নতুন উপযোগী ভেরিয়েন্টের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকবে, জন্ম নিতে পারে ‘সার্স-কোভ-৩’। ‘স্পাইক প্রোটিনে মোড়ানো নির্জীব সামান্য এক জেনেটিক কোড’-এর বিরুদ্ধে মানবজাতির বিজয় হয়তো সুনিশ্চিত, কিন্তু এ যুদ্ধে তাদের নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা পুরোটাই নির্ভর করবে কত দ্রুত তারা সংক্রমণ চক্র ভাঙতে পারছে, তার ওপর। টিকা এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখলেও তড়িৎ সমগ্র জনগোষ্ঠীকে তার আওতায় আনা না গেলে টিকাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে বাধাগ্রস্ত হয়ে উদ্ভাবিত নতুন ভেরিয়েন্টটি অবশিষ্টদের জন্য আরও বেশি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘হাই এফিকেসি’ টিকা দিয়ে ভাইরাসটির বংশবিস্তারে কঠোর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে অর্থাৎ ‘হার্ড-ব্রেক’ টানা হলে এ টিকা প্রতিরোধই পক্ষান্তরে আরও সংক্রমণশীল ভেরিয়েন্টের জন্ম দিতে পারে, যা হয়তো খোদ টিকার সুরক্ষাব্যূহকেও ফাঁকি দিতে পারবে। যারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত রেখে নিজেরা কেবল দুই ডোজ টিকা নিয়ে স্বস্তিতে থাকতে চাইছে, তারাও তখন রেহাই পাবে না। এমন অবস্থায় বিজ্ঞানীরা ‘ডাবল ডোজ’ পরিহার করে সব নাগরিককে কেবল একটি ‘ডোজ’ টিকা প্রয়োগ করে মধ্যম পর্যায়ের একটি সামগ্রিক সুরক্ষাবলয় তৈরি করার পক্ষে মত দিয়েছেন, যেখানে মানুষ ও ভাইরাস একধরনের সহাবস্থানে থাকবে এবং নতুন কোনো ভেরিয়েন্টের জন্ম না দিয়ে ভাইরাসটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এভাবে চলতে চলতে পরবর্তী পর্যায়ে অবস্থা বুঝে হয়তো আরেকটি ‘ডোজ’ দেওয়া যেতে পারে। তবে ‘দ্বিতীয়’, ‘তৃতীয়’ কিংবা ‘বুস্টার’, যত ডোজই প্রয়োগ করা হোক না কেন, মানবজাতির চূড়ান্ত বিজয়ের মন্ত্র ‘টিকা নয়’, কেবল ‘সংক্রমণ চক্র’ ছিন্ন করা! কেননা, কোনো ‘হোস্ট’ না পেলে ভাইরাসটি কিছুতেই বংশবিস্তার করতে পারবে না। তবে ‘কোভিড-১৯’ ক্রমান্বয়ে আরও বেশি মরণক্ষম হয়ে ওঠার কোনো আশঙ্কা নেই, কেননা তা তার বংশবিস্তারে কোনো ‘নির্বাচনী সুবিধা’ দেয় না। খোদ ‘ক্যারিয়ার’কেই মেরে ফেললে তাদের হয়ে সংক্রমণ ছড়াবে কে? বরং মারাত্মক কোনো ভেরিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটলে বাহকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে ধরনটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়।
শিল্পবিপ্লবের ধোঁয়ায় শ্বাসতন্ত্র তো রীতিমতো ঝাঁজরা হয়ে গেছে! আধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে সাজানো মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থা যে কত ফাঁপা, তা হয়তো এর আগে কারও জানাই ছিল না। বায়ুমণ্ডলের ২১ শতাংশই অক্সিজেন, তথাপি শুধু নিশ্বাস নিতে না পেরে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
বস্তুত করোনাভাইরাস যতটা না জীবনঘাতী, আক্রান্ত মানুষের জীবনহানি ঘটছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি, যা মানুষের নিজেদের স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোরই চরম দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। ‘হান্টার গ্যাদারার’র থেকে কৃষিজীবী হতে গিয়ে মানুষ সংখ্যায় বেড়েছে বটে, কিন্তু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে কালে কালে নিজেদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে তারা তলানিতে নিয়ে ঠেকিয়েছে। শিল্পবিপ্লবের ধোঁয়ায় শ্বাসতন্ত্র তো রীতিমতো ঝাঁজরা হয়ে গেছে! আধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে সাজানো মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থা যে কত ফাঁপা, তা হয়তো এর আগে কারও জানাই ছিল না। বায়ুমণ্ডলের ২১ শতাংশই অক্সিজেন, তথাপি শুধু নিশ্বাস নিতে না পেরে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। তাই অবশ্যম্ভাবী পর্যায়ক্রমিক ঢেউ মোকাবিলায় প্রাণহানি ঠেকাতে সবার আগে প্রয়োজন সারা দেশে আবশ্যিকভাবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ও হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলাসংবলিত বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো প্রস্তুত করা, যা মোটেও কোনো দুঃসাধ্য কাজ নয়।
সহাবস্থান ও পর্যায়ক্রমিক নিয়ন্ত্রণের কৌশলে না গিয়ে করোনাভাইরাসটিকে যত কোণঠাসা করা হবে, ‘সিলেকশন প্রেশার’ বা নির্বাচনী চাপে তত দ্রুত তার পরিবর্তন ঘটবে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভিনব সব লাগসই সক্ষমতাসম্পন্ন নতুন প্রজাতির বিকাশ ঘটবে, যা হয়তো-বা অবলীলায় বাতাসে উড়ে বেড়াবে এবং মানবসৃষ্ট সব প্রতিরোধকে সহজেই ফাঁকি দিতে পারবে। কিংবা এখনকার চেয়ে আরও কমসংখ্যক ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে মানুষকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলবে, যাদের হয়তো দু-তিন স্তরের মাস্ক দিয়েও আটকে রাখা যাবে না। অতিমারি-মহামারিকালে ভাইরাসের নতুন নতুন ভেরিয়েন্টের পাশাপাশি আবির্ভাব ঘটে নানা রকম ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের, যা স্বাভাবিক সময়ে ডরমেন্ট বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ তারই একটি নমুনা।
এ রকম ভয়ানক পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতৃত্ব, রাষ্ট্র ও সমাজ ভাইরাসের ‘সংক্রমণ–শৃঙ্খল’ ভাঙতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেও ‘হোমো স্যাপিয়েনস’ নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না। প্রাণী হিসেবে তার জন্য এটা ‘অস্তিত্বের প্রশ্ন’! মিউটেড করতে করতে তারা নিজেরাও হয়তো একসময় ‘ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস রেজিস্ট্যান্ট’ নতুন মানুষে পরিণত হবে। আর এভাবেই পরজীবী সংক্রমণ, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধনশীল ডেটা প্রবাহসহ নানা নির্বাচনী চাপে পড়ে পরিবর্তিত হতে হতে তারা বদলে যাওয়া এক প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। স্যাপিয়ানস গ্রন্থের বিশ্বখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি মানুষের সম্ভাব্য বদলে যাওয়া এ প্রজাতির নাম দিয়েছেন ‘হোমো ডিয়াস’, যা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা তাঁর পরবর্তী গ্রন্থটিরও নাম। তবে সর্বংসহা ও সর্বজয়ী এসব প্রজাতির মধ্যে ‘মনুষ্যত্ব’ টিকে থাকবে তো?
মোজাম্মেল বাবু এডিটরস গিল্ডের সভাপতি ও একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক