চলতি বছরের গোড়ায় আমি আর্থিক বাজারের গতি–প্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম। তখন আমার চোখে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ধরা পড়ছিল। সে সময় অনেক সম্ভাব্য ঝুঁকিও দেখছিলাম যেগুলো এখন যতটা স্পষ্ট, তখন ততটা ছিল না। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন রাশিয়া সবে ইউক্রেনের সীমান্তে বিপুলসংখ্যক সেনা জড়ো করতে শুরু করেছে, কিন্তু তখনো হামলা চালায়নি। এখন রাশিয়া পুরোদস্তুর আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করেছে। এর জের ধরে মস্কো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং বাজারব্যবস্থা থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের নীতিগত অবস্থানে একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আজকের এই মুদ্রাস্ফীতি একটি নিছক ক্ষণস্থায়ী ঘটনা এবং এটি আপনা-আপনিই ঠিক হয়ে যাবে—কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো শেষমেশ এই ধারণা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন ইচ্ছাকৃতভাবেই উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বৈশ্বিক আর্থিক অবস্থাকে (প্রধানত তাদের ব্যালান্স শিট উন্মুক্ত করে দিয়ে এবং সুদের হার বাড়িয়ে) কড়াকড়ির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। এই কড়াকড়িতে পরিবারগুলোর ওপর চক্রবৃদ্ধি হারে চাপ যোগ হচ্ছে। এইভাবে একই ধরনের চাপ যুক্ত হচ্ছে বৃহত্তর অর্থনীতিতে।
বিশ্বের দ্বিতীয় এবং রাশিয়ার চেয়ে ১০ গুণ বড় যে চীনা অর্থনীতি, সেটির গতিও সি চিন পিং সরকারের ‘জিরো কোভিড’ কৌশলের কারণে শ্লথ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের ওপর আরেকটি বৈশ্বিক মন্দা ধেয়ে আসতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে সেটি হবে ২০২০-২১ সালের লকডাউনজনিত খুদে মন্দার পর আকস্মিকভাবে নেমে আসা মহামন্দা। এখন প্রশ্ন হলো, এই মন্দা কতটা খারাপের দিকে যাবে? এমন কোনো নীতি কি আছে যা সেটিকে এড়াতে পারবে বা নিদেনপক্ষে এর তীব্রতা কমিয়ে আনতে পারবে?
চীনে নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, কোভিড-১৯ সামাল দেওয়ার বিষয়ে ঢিলেঢালা অবস্থান নিলে তা সংক্রমণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। আমরা ইতিমধ্যে এই ধরনের ঘটনা ইউরোপে দেখেছি। বিশেষত যুক্তরাজ্যে ২০২০-২১ সালে সেখানে প্রথমে ঢিলেঢালা অবস্থান নেওয়া হয়েছিল এবং তার কারণে অবস্থার অস্বাভাবিক অবনতি হয়। সেখানে তারা আচমকা কঠোর লকডাউন আরোপ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই দিক থেকে সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্ক থাকার ব্যাপারে চীনের সমালোচনা খুব কমই করা যেতে পারে।
জ্বালানি ও খাদ্যমূল্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়া এবং প্রকৃত আয় কমে যাওয়া ভোক্তাদের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তাদের নতুন কোনো রোমাঞ্চকর সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবতে হচ্ছে। যদি দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং সেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা না যায়, তাহলে গোটা বিশ্বের আর্থিক হিসাব–নিকাশ উল্টে যাবে।
এ পর্যন্ত যেসব তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, করোনাভাইরাসের সর্বশেষ বৈশ্বিক ধরন অমিক্রন এতটাই সংক্রমণশীল যে এমনকি লকডাউন দিয়েও এর ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায় না। এই ধরন আগের ধরনটির তুলনায় কম প্রাণঘাতী বলে মনে হয়। ফলে অমিক্রন ঠেকাতে লকডাউনের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না। চীনের এই অদূরদর্শী লকডাউনভিত্তিক ‘জিরো-কোভিড’ কৌশলটি ইতিমধ্যে দেশটির অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলেছে। সাম্প্রতিকতম বাণিজ্য তথ্য (এপ্রিল মাসের) দেখা যাচ্ছে, চীনা আমদানি ব্যতিক্রমীভাবে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। যেসব লক্ষণ কোনো দেশের অর্থনীতির দুর্বলতার আভাস দেয়, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
চীন যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, অর্থনীতি ও বাজারের বাইরেও তার প্রভাব রয়েছে। চীনের ক্ষমতাসীন একদলীয় নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে দেশের ১৪০ কোটি মানুষের জন্য ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করে তার শাসনকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হতে থাকলে সেই অলিখিত চুক্তি সহজে বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায় না। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চীনের বিষয়–আশয় নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদে আমি বলতে পারি, চীনা সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তার ব্যতিক্রম ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। অতীতে তারা সময়োপযোগী পদ্ধতিতে বড় বড় সম্ভাব্য সমস্যা মোকাবিলা করেছে। কিন্তু আজ তারা তা করছে না বলে মনে হচ্ছে। যদি শিগগিরই তারা তাদের ‘জিরো-কোভিড’ নীতি থেকে সরে না আসে, তাহলে তা তাদের অর্থনীতির জন্য তো বটেই; বাকি বিশ্বের জন্যও আরও অনেক দুঃখ বয়ে আনবে।
চীনের বাইরে বাকি বিশ্বে দুটি প্রধান বিষয় ঠিক করবে বিশ্বের আগামী দিন কেমন যাবে। সে দুটি বিষয়ের একটি হলো প্রধান প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি এবং অপরটি হলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন আসলে কী করতে যাচ্ছেন, তা তিন মাস আগে তিনি যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছিলেন, তখনো আগে থেকে বোঝা যায়নি, আজও বোঝা যাচ্ছে না। ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের আকস্মিক আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, পুতিন হিসাব–নিকাশে ভুল করেছেন। কারণ এই যুদ্ধ শিগগিরই তাঁর পক্ষে শেষ করা না–ও হতে পারে এবং তাঁর মূর্খতার জন্যই তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হতে পারে (যদিও ক্রেমলিনপন্থী অনেকে এটিকে অসম্ভব মনে করেন)।
জ্বালানি ও খাদ্যমূল্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়া এবং প্রকৃত আয় কমে যাওয়া ভোক্তাদের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তাদের নতুন কোনো রোমাঞ্চকর সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবতে হচ্ছে। যদি দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং সেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা না যায়, তাহলে গোটা বিশ্বের আর্থিক হিসাব–নিকাশ উল্টে যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (যে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নীতি পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে) সর্বশেষ ভোক্তামূল্য সূচক দেখাচ্ছে, সেখানে মূল মুদ্রাস্ফীতি এখনো ৬ শতাংশের ওপরে। পরিষেবা-খাতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। এ অবস্থায় ফেডারেল রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে কড়া অবস্থানে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে তারা শিগগিরই সরে আসবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে যদিও অর্থনৈতিক পতন ইউরোপের মতো গুরুতর হয়ে ওঠেনি, তবে এটি তাৎপর্যপূর্ণ চেহারা নিয়েছে এবং আর্থিক
ব্যবস্থায় কড়াকড়ি তা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার বীজ বপন করতে পারে।
তাহলে আমরা কি নতুন একটি বৈশ্বিক মন্দার দিকে যাচ্ছি? ফেডারেল রিজার্ভ, চীনা নেতৃত্ব এবং ক্রেমলিনের বিচ্ছিন্ন নেতৃত্বের ওপর তার অনেক কিছু নির্ভর করছে।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও প্যান ইউরোপিয়ান কমিশন অন হেলথ অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের একজন সদস্য