২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

প্রবীণনিবাস দুঃখের নয়, আনন্দের স্থানও হতে পারে

প্রবীণনিবাসে বসবাসের কথা শুনলেই আমাদের মন খারাপ করতে হবে এবং যাঁরা তাঁদের মাতা-পিতাকে নিবাসে পাঠিয়ে দেন, তাঁদের সম্পর্কে কটু ধারণা পোষণ করতে হবে। প্রবীণনিবাস বাংলাদেশে কেন প্রয়োজন, তা কেউ ঠিকমতো বোঝাতে পারছেন না। তবে ১৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোতে লেখক দিলরুবা কবির তাঁর লেখায় (প্রবীণনিবাস নিয়ে নেতিবাচক ধারণা নয়) কিছুটা বুঝিয়েছেন। তাঁকে এবং প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।

প্রবীণদের বেশ কয়েকটি বাসস্থান দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। একজন নিবাস-পরিচালকের সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়। প্রথম দেখায় জানতে চেয়েছিলাম তিনি কেন বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করেছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ মানুষকে সেবা দিতেন। তিনি সব বাড়িতেই প্রবীণদের ঘিরে অশান্তি লক্ষ করেছেন এবং সে কারণেই তাঁর মনে একটি নিবাস শুরু করার তাগিদ জেগেছিল।

আমাদের দেশের মানুষের আয় কম। বৃদ্ধকালের জন্য সঞ্চয় সম্ভব হয় না। বৃদ্ধকালে তাঁরা উপার্জনক্ষমও থাকেন না। তাই একসময় তাঁরা সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে পড়েন। সন্তানদের ইচ্ছা থাকলেও ভালোমতো বৃদ্ধ মাতা-পিতার যত্ন নিতে পারেন না। অনেক নিবাসে গিয়ে অনেক সর্বহারা মানুষকে দেখেছি। ছেলেমেয়েরা তাঁদের রাস্তায় ফেলে রেখে চলে গেছে। অমানবিক মনে হলেও সত্য।

আমাদের সমাজ বদলেছে, সমাজের ব্যবস্থা বদলেছে। শহুরে জীবন আমাদের একসঙ্গে থাকতে দেয় না। আমাদের স্থাপত্য দেখলেই তা বোঝা যায়। সন্তানের স্বল্প উপার্জনে মা-বাবার সেবা করা সম্ভব হয় না। আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাই ছোট ছোট পরিবার নিয়ে বসবাস করতে বাধ্য করছে। এখন লাখ লাখ বৃদ্ধ মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা একা বসবাস করেন। উচ্চ মধ্যবিত্ত অনেকের সন্তানেরা বিদেশে বসবাস করেন। এই মানুষগুলো একা, দেখার কেউ নেই।

আমাদের সমাজ বদলেছে, সমাজের ব্যবস্থা বদলেছে। শহুরে জীবন আমাদের একসঙ্গে থাকতে দেয় না। সন্তানের স্বল্প উপার্জনে মা-বাবার সেবা করা সম্ভব হয় না। আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাই ছোট ছোট পরিবার নিয়ে বসবাস করতে বাধ্য করছে। এখন লাখ লাখ বৃদ্ধ মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা একা বসবাস করেন। উচ্চ মধ্যবিত্ত অনেকের সন্তানেরা বিদেশে বসবাস করেন। এই মানুষগুলো একা, দেখার কেউ নেই।

আমরা যেমন করে নগরায়ণে মেতেছি, তা দেখে মনে হয় এর প্রভাব মফস্বল শহরে এবং গ্রামেও ছড়িয়ে পড়বে। সেখানেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। দুই ভাইয়ের পরিবার দুই বাসায় এবং মা-বাবা আরেক বাসায় থাকবেন। এ প্রক্রিয়া আমরা এখন আর রুখতে পারব বলে মনে হয় না। চাহিদার কারণেই এমনটা হবে। ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের জীবন আরও বেশি একাকী হবে।

গত বছর একটি খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সমাজের বয়স বাড়ছে। প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। একটি দেশকে তখনই প্রবীণ বলা যায়, যখন ৭ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বছরের বেশি হয়। এর পরের সাত বছরে যদি সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়, তাহলে সেটি বৃদ্ধদের দেশে পরিণত হয়। ইউনিসেফ জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটবে ২০২৯ সালে এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে এ দেশ এক প্রবীণসমাজে পরিণত হবে। বলা হচ্ছে বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা জাপানের চেয়েও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জাপানের একটি উদাহরণ দিই। সেখানে প্রবীণদের সংখ্যা এতই বেশি এবং তাঁরা এতই একা যে তাঁরা নিজেরা কারাগারে ঠাঁই নেওয়ার জন্য ইচ্ছা করে অপরাধ করেন। কারাগারে গেলে সেখানে একটি সমাজ পাওয়া যাবে, কিন্তু নিজের বাড়িতে কেউ নেই। জাপানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারি। সে কারণেই আমাদের আরও অনেক বেশিসংখ্যক প্রবীণনিবাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্তত প্রতি জেলায় একটি করে।

হ্যাঁ, মনে হতে পারে এ এক নিষ্ঠুর পরামর্শ। তবে চিন্তা করে দেখুন, নিজের বাড়িতে নিঃসঙ্গ থাকার চেয়ে নিবাসে গিয়ে বাস করলে অনেক সঙ্গী-সাথি পাবেন, কথা বলার মানুষ পাবেন। অসুস্থ হলে তখনই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য পাবেন। আমার মনে হয় তাঁরা ভালো থাকবেন। ছেলেমেয়েরা সব সময়ই দেখা করতে আসবেন। আমরা হয়তো আমাদের প্রবীণ মানুষের সংখ্যাটি জানি, তবে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানি না। প্রবীণনিবাসে বসবাস হবে তাঁদের জন্য অন্য রকম একটা সুযোগ। সন্তানের দুশ্চিন্তার কারণ না হয়ে একটি পেশাদার আশ্রমে গিয়ে বসবাস করবেন।

আরও পড়ুন

এখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে সব জেলায় প্রবীণনিবাস তৈরির অর্থ আসবে কোথা থেকে? আমাদের দেশে বিভিন্ন শ্রেণির বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন—ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং একেবারেই গরিব। এ দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ধনী মানুষ ছাড়া আর কেউই বয়স্ককালের জন্য সঞ্চয় করতে পারেন না। সরকারি ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্মাণ খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ধনীদের তেমন সমস্যা হবে না। কেউ যদি প্রবীণদের জন্য কোনো কনডোমিনিয়াম তৈরি করে, তাঁরা কিনে নিতে পারেন। অনেকেই এমন পরিকল্পনা করছেন।

একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে এ বিষয়টি বোঝাই। ১৯৯৯ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে প্রবীণ হিতৈষী সংঘে গিয়েছিলাম। দেখি ৩০০ ঘরের একটি নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। সব সুযোগ-সুবিধা আছে। যে প্রবীণ ব্যক্তিরা মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে বসবাস করতে পারবেন, তাঁরাই থাকবেন। সে সময়ই কর্তৃপক্ষ পাঁচ হাজারটি আবেদন পেয়েছিল। এখন সেই সংখ্যা কত হতে পারে, একবার চিন্তা করুন।

তাহলে গরিব প্রবীণদের কী হবে? সরকার পদ্মা সেতু বানাতে পারলে ৬৪টি প্রবীণনিবাস তৈরি তার কাছে কিছুই নয়। বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সবগুলোই সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর তহবিল থেকে সমাজের জন্য কাজ করে। অনেক খাতে রেগুলেটর নিজ থেকে সিএসআরে খরচ করা আবশ্যিক করে দেয়। সরকার সব খাতকে সিএসআরের আওতায় গুছিয়ে নিয়ে এসে এ কাজ করতে পারে। সরকার জমি দেবে, এক প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো তৈরি করবে এবং আরেকটি প্রতিষ্ঠান নিবাসের পরিচালন ব্যয়ের দায়িত্ব নেবে। অর্থ খুব একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয় না।

যাত্রাটি অনেক লম্বা। তবে প্রবীণদের জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে, তাঁদের ভালো রাখার সদিচ্ছা থাকতে হবে। প্রবীণেরা হয়তো বর্তমানে অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন না, তবে একসময় অর্থনীতি তাঁরাই এগিয়ে নিয়েছেন। সময় এসেছে প্রবীণনিবাসকে বাস্তব চোখে দেখার, নেতিবাচকতা দূর করার। নচিকেতার সেই গান এবং আলবেয়ার কামুর উপন্যাসের নায়ক ম্যোরসোর মায়ের স্মৃতি আমাদের মানসে ভর করে আছে। প্রবীণনিবাস দুঃখের স্থান নয়, আনন্দের হতে পারে।

  • ইকরাম কবীর গল্পকার এবং যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত