তেরো শতকে তুর্কি, কিছুকাল পর পর্তুগিজ, ষোড়শ-সতেরো শতকে ফরাসি, আঠারো শতকে ইংরেজি এবং পাকিস্তানি শাসনামলে উর্দুভাষীরা বাংলার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে-গোপনে ষড়যন্ত্র করেছে, শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে। এসব আক্রমণ-বিবর্তনের পরও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য স্বাতন্ত্র্য আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের প্রথম ভাষা বাংলা। ২০১০ সাল থেকে বাঙালির ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। এত সব গৌরব ও বিশ্বের অন্যতম দ্রুত সম্প্রসারণশীল ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে একটি শ্রেণি প্রতিনিয়ত অবলীলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে তছনছ করছে ।
বর্তমানে প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার কোনো শত্রু নেই। প্রকাশ্যে বাংলার বিরুদ্ধাচরণ সম্ভবও নয়। সবাই প্রকাশ্যে বাংলা চায়, বাংলা ভাষার স্তুতি করে। সংবিধানে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী, নানা অংশ সংযোজন-বিয়োজন হলেও তৃতীয় অনুচ্ছেদে কোনো আঁচড় লাগেনি, যেখানে তিন শব্দে উল্লিখিত বাক্য ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ প্রথম থেকেই বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে স্বদেশে দিন দিন দ্বিতীয় ভাষায় পরিণত হচ্ছে বাংলা । এ কি কোনো সুচারু শত্রুতা, ষড়যন্ত্র নাকি বাংলার প্রতি অনীহা?
শিক্ষা এলাকায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে বাংলা ভাষা; প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় প্রশাসন এলাকায়, গুরুত্বহীন থাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, বাধাগ্রস্ত হয় উন্নয়ন পরিকল্পনায়, সর্বোপরি বিলীন হয় বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে। ‘উন্নয়নপ্রক্রিয়ার প্রবণতাই হচ্ছে উন্নয়নের ভাষারূপে মাত্র একটি ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা।’ একাধিক ভাষার ব্যবহার উন্নয়নের কাজে নানা রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় ওপরের অংশে, বিশেষ করে পরিকল্পনা পর্যায়ে, ইংরেজি ভাষার একচ্ছত্র প্রভাব বিদ্যমান। যদি শুধু বাংলাকেই উন্নয়নের ভাষারূপে ব্যবহার করা হতো, তবে বাংলা ভাষা দ্রুত মানরূপ পেত-নতুন শব্দ গঠিত হতো, বাক্য সংগঠনে শৃঙ্খলা অর্জন করত।
সর্বস্তরে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজির বিস্তার, ব্যাপকভাবে ব্যবহার কখনো কখনো দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ বা রাজনীতিক চাপে বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি।
বাংলাদেশে প্রযুক্তির ভাষা ইংরেজি, প্রযুক্তিশিক্ষার ভাষাও ইংরেজি। দেশের প্রযুক্তিবিদ, ব্যবস্থাপকেরাও কার্যক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করেন। অধিকাংশই এখনো ইংরেজিনিষ্ঠ, ইংরেজিই যেন তাদের শিক্ষা, আভিজাত্য ও যোগ্যতার মানদণ্ড। দেশীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার ক্ষেত্রে ইংরেজিকেই অবলম্বন করা হয়। যখন কোনো গবেষক বাংলা ভাষায় সমাজ-রাষ্ট্রের নানা ক্রিয়াকলাপ-প্রক্রিয়া ব্যাখ্যায় করেন, তখন তিনি উদ্ঘাটন করতে চান বিষয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র।আর যখন ইংরেজিতে লেখেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী।
স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা যোগ্যতার অন্যতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হলেও বর্তমানে ইংরেজি সে জায়গা দখল করেছে। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার বিচারে, নিয়োগ, যোগ্যতা-দক্ষতার ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলার কোনো স্থান যেন নেই। এ কারণে বাংলাকে অবলম্বন করা বা শেখার আবশ্যকতা নেই। ইংরেজিতেই অনেকের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষিত হয় বলে ইংরেজি ব্যবহারেই তাঁরা বেশি উৎসাহ বোধ করেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নতুন পদ, শাখা-প্রশাখা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাক্রম, কোম্পানি, বিজ্ঞাপন সর্বস্তরে আজ ইংরেজি-বাংলার সংঘর্ষ; বাংলা ভাষার বিশৃঙ্খলা ও ব্যর্থতা। যেখানে নতুন নতুন পরিভাষা তৈরি হওয়ার কথা, শুদ্ধ-নির্ভুল বাংলা লেখার কথা, সেখানে উপযুক্ত-ঝলমলে বাংলা শব্দ-বাক্য বাদ দিয়ে ইংরেজি শব্দ বাংলা বর্ণমালায় লেখা হচ্ছে, বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণে শব্দ-বাক্য তৈরি করা হচ্ছে। এ ধারায়, প্রতিবর্ণীকৃত রূপের প্রয়োগ থেকে বাদ যাচ্ছে না ‘বাঙালি’, ‘ভাষা’, ‘আন্দোলন’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিসংগ্রাম’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘স্বাধীনতা’, ‘মানচিত্র’, ‘পতাকা’, ‘দেশ’ প্রভৃতি চেতনাদীপ্ত ও ঐতিহাসিক শব্দগুলোও।
শুধু দেশাত্মবোধক ও জনসচেতনতামূলক বাণী দিয়ে বাংলা ভাষার শত্রুদের থামানো যায় না, বিদেশি ভাষার আগ্রাসনও প্রতিরোধ হয় না। উনিশ ও বিশ শতকে হাঙ্গেরিয়ান জনগণ প্রতিরোধ করতে পারেনি জার্মান ভাষাকে। জাপানিরা জনসচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও প্রয়োগে তাদের ভাষার ব্যবহার আবশ্যিক করেছে। চীনের ভাষার মধ্যে কোনো বিদেশি ভাষার শব্দ-বাক্য মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে না বলে সরকার আইন করেছে। বাংলাদেশেও ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ এবং ২০১২ ও ২০১৪ সালে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন, বেতার-দূরদর্শনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও দূষণ রোধে হাইকোর্টের রুল জারি হয়েছে। সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন যেন দেশে নেই-নেই কোনো জবাবদিহির নজির।
একক-নির্দিষ্ট রাষ্ট্রভাষার দেশে যথোপযুক্ত বাংলা শব্দ-বাক্যকে নির্বাসিত করে বিদেশি ভাষার ব্যবহার শুধু বাংলার সঙ্গে শত্রুতা নয়, রাষ্ট্র, সমাজ ও দেশের সঙ্গেও শত্রুতা; সংবিধানে উল্লিখিত ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা। একটি শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে, আরেকটি শ্রেণি অসাবধানতায় বাংলা ভাষাবিরোধী ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল, শিক্ষা, চাকরি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে গুরুত্ব পেয়েছিল পঁচাত্তরের পর সেই স্রোত বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে-তীব্রতা পায় প্রতিক্রিয়াশীলতা।
সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদ বজায় রেখেও ‘বেতার’, ‘চালনা বন্দর’, ‘পৌরসভা’, ‘রাষ্ট্রপতি’ প্রভৃতি ‘রেডিও’, ‘পোর্ট অব চালনা’, ‘মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন’, ‘প্রেসিডেন্ট’ হয়ে ওঠে। একুশের সূত্রেই যে প্রোথিত বাংলার শোষিত শ্রেণি, প্রগতিশীলতা, স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধক, দেশপ্রেম, বাঙালির গর্ব ও মৌলিকত্ব, সেই কথাও আজ অপাঙেক্তয়। সে কারণে বলা যায়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ কথাটি আজ প্রহসন।
ড. মুহম্মদ মনিরুল হক সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার।
[email protected]