পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে—এ রকম একটি ধারণা সবখানেই আছে। ভারতের লাদাখ অঞ্চলে চীনের সর্বশেষ হানা এ ধারণাকে সমর্থন করে। তিব্বত লাগোয়া খনিজসমৃদ্ধ এই উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সম্পদের আধার বলে পরিচিত।
চীনের সেনারা সীমানা লঙ্ঘন করে লাদাখের যতটুকু এলাকায় ঢুকেছে, সে এলাকায় একটাও বড় নদী বা জলাধার না থাকতে পারে, সেখানকার পানি নিয়ে চীনের মাথাব্যথা না–ও থাকতে পারে, কিন্তু ১৯৫০ সাল থেকে নিজের কবজায় থাকা তিব্বতের পানি চীনের জন্য জীবন মরণের প্রশ্ন।
তিব্বতকে বলা হয় ‘থার্ড পোল’ বা ‘তৃতীয় মেরু’ বা ‘বিশ্বের পানির চূড়া’। আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকার পর তিব্বতেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলাধার আছে।
তিব্বত দেশটা আস্ত একটা মালভূমি, যা কয়েক ডজন নদীর উৎস। এ নদীগুলো তিব্বত থেকে নেমে চীন, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় পড়েছে এবং বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করছে।
তিব্বত থেকে জন্ম নেওয়া নদীগুলোর আশপাশের যত এলাকায় চীন নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, তার জন্য সেটি ততটা স্বস্তির হবে
তিব্বত থেকে নেমে আসা নদীগুলো চীনের খাওয়ার পানি সরবরাহ করে। জটিল প্রক্রিয়ায় শত শত খাল কেটে সেই খালগুলোকে এ নদীগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে কৃষি খামারে তারা সেচ দেয়।
সিঙ্গাপুরের ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো বলেছেন, চীনের যে দৃশ্যমান ‘অ্যাকিলিস হিল’ বা ‘চরম দুর্বলতা’ আছে, সেটি হলো দেশটির নদীব্যবস্থা। নদীগুলো আক্ষরিক অর্থেই চীনের জীবননালি হিসেবে কাজ করছে।
রায়ান ক্লার্ক বলেছেন, তিব্বত থেকে জন্ম নেওয়া নদীগুলোর আশপাশের যত এলাকায় চীন নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, তার জন্য সেটি ততটা স্বস্তির হবে। চীন মনে করে, তার নদী ব্যবস্থাপনা এবং নদীর দিক পরিবর্তন কার্যক্রম যদি কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে সেটি তার জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে।
চার দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতাবিশিষ্ট রণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সিয়াচেন হিমবাহে ভারত যে সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে রেখেছে, তা চীনকে বিচলিত করার জন্য যথেষ্ট। উপরন্তু ২০১৯ সালে ভারতের এক অতি জাতীয়তাবাদী মন্ত্রী গোটা আকসাই চীন আবার দখল করে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পর চীনের অধিক বিচলিত হওয়াই স্বাভাবিক।
চীন তার উত্তরাঞ্চলের খাওয়ার পানি এবং সেচের পানি নিশ্চিত করতে ইয়াংসি এবং পীত নদীর ওপর নির্ভর করে। তিব্বতের সুমাতান পয়েন্ট থেকে সৃষ্ট সাউদিয়ান ক্যানালের মাধ্যমে চীনের পূর্ব উপকূলীয় তিয়ানজিন এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয়।
ভূতাত্ত্বিকেরা বলছেন, চীন এখন তিব্বতের ইয়ারলাং সাংপু নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে জিনজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যেতে চাইছে।
ইয়াংসি ও পীত নদী ছাড়াও সালউইন, ইরাবতী, মেকং, ইন্দুজ, সাতলুসসহ বহু নদীর উৎপত্তিস্থল হলো তিব্বত। ইয়ারলাং সাংপু নদী ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে ভারতের উত্তর–পূর্ব অঞ্চল এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
চীন প্রচণ্ড গতিতে শিল্পায়নের বিস্তার ঘটিয়েছে এবং পর্যটন বাড়ানোর জন্য বেইজিং থেকে লেহ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ১০০ কিলোমিটারের রেললাইন বসিয়েছে। এতে হিমবাহ গলেছে এবং তিব্বতের জলাধারের পানির পরিমাণ ও মান দুটোই কমেছে।
এর বাইরে বাঁধ দিয়ে চীন নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ায় অনেক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নভূমির দেশগুলো এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন মেকং নদীতে চীন এতসংখ্যক বাঁধ দিয়েছে যে তার কারণে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে খরা দেখা দিচ্ছে।
তিব্বত থেকে ছুটে আসা পানির গতিপথে চীনের বাধা সবচেয়ে দুর্দশায় ফেলছে ভারতকে। আর তিব্বতের সব পানি ইচ্ছেমতো ভোগদখল করার জন্যই চীন পঞ্চাশের দশকে ভারতের আকসাই চীন ও লাদাখের প্রায় ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছিল।
চীন সর্বশেষ লাদাখের যে জায়গায় সীমানা লঙ্ঘন করে ঢুকেছে, সেখান থেকে ইন্দুজ নদীর (তিব্বত থেকে উদ্ভূত এই নদী প্রথমে ভারতে পড়েছে এবং ভারত হয়ে পাকিস্তানে পড়েছে) দূরত্ব খুবই কম। গালওয়ান উপত্যকায় চীন সেনারা ভারতীয় সেনাদের ওপর হামলার পর অনেকেই এখন গালওয়ান নদী চীন দখল করে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।
মোদ্দা কথা, চীনের এ আগ্রাসী মনোভাবের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ তিব্বতের পানির যথেচ্ছ ব্যবহার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া
সুমিত শর্মা: ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক