পাকিস্তানে এখনো এমন লোকের অভাব নেই, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যা বেমালুম অস্বীকার করে। এটি একটি অস্বস্তিকর সত্য, যা মুখে স্বীকার না করে নোংরা কার্পেটের নিচে ঠেলে রাখাই তাদের জন্য অধিক নিরাপদ। আবার এমন অনেক লোকও আছে যারা মনে করে, দুঃখ প্রকাশ তো হয়েছে, এই নিয়ে আর বিতর্ক কেন? তার চেয়ে বরং আসুন, সামনে এগোই।
এ কথা ঠিক, পাকিস্তান ফিসফিস করে বার কয়েক ‘সরি’ বলার চেষ্টা করেছে। কেন এই দুঃখ প্রকাশ, তার অবশ্য কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি। পাকিস্তানের কেউ কখনো একাত্তরের ঘটনাবলিকে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকার করেনি। তাদের কেউ কখনো বিশ শতকের অন্যতম প্রধান মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য কোনো নৈতিক দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। সে ঘটনার জন্য দায়ী একজন পাকিস্তানিকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য পাকিস্তানের আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রথম সরকারি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর দায়িত্ব পড়েছিল হামুদুর রহমান কমিশন নামে একটি তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির ওপর। এরপর প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো সেই কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিনের আলো দেখেনি। ১৯৭২ সালে ওই কমিশন যখন প্রাথমিকভাবে কাজ শেষ করে প্রতিবেদনের কপি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে তুলে দেয়, তখন তিনি একটা ছাড়া প্রতিবেদনের বাকি সব কপি নষ্ট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে অতিরিক্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় একটি ‘সম্পূরক’ অধ্যায় যুক্ত করা হয়, সেটিও প্রকাশ করা হয়নি। পরে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় তার কিছু অংশ ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তান বাধ্য হয়েই তা প্রকাশ করে। তখনো কিন্তু পুরো প্রতিবেদন অবমুক্ত করা হয়নি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদনের একটি পূর্ণাঙ্গ কপি চেয়েছিল। ‘অতি গোপনীয়’ অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তান তা বাংলাদেশকে দেয়নি।
পূর্ণাঙ্গ হোক বা না হোক, এই প্রতিবেদনের যতটুকু আমাদের হাতে এসেছে, তাতে ইতিহাস বিকৃত করার যে চেষ্টা পাকিস্তানে সরকারিভাবে করা হয়, তার পুরো ছবিই ধরা পড়ে। বিবেচনা করুন, এই প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৭১-এ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বাঙালির সংখ্যা ৩০ লাখ নয়, বড়জোর ২৬ হাজার। যে দুই লাখ নারী ধর্ষিত হন, তা পুরোপুরি মিথ্যা বলে দাবি করা হয়েছে। আর বলেছে, ১০ লাখ উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, সেটিও নাকি বাঙালিরা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে।
একাত্তরের নৃশংস গণহত্যার আসল ছবিটি লুকিয়ে রাখার সব চেষ্টাই পাকিস্তানি নেতারা করেছেন। ১৯৭২ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির কাছে দাবি করেছিলেন, একাত্তরে বড়জোর ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়। নারী ধর্ষণের যে কথা বাংলাদেশ দাবি করে, সেটিও মিথ্যা। জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে বলেছিলেন, বড়জোর জনা চারেক নারী ধর্ষিত হন। ভুট্টো ফালাচিকে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘ঠিক আছে, ৪ জনকে নাহয় আপনি ১০ দিয়ে গুণ করলেন, তাতে দাঁড়ায় ৪০ জন। মুজিব আর (ইন্দিরা) গান্ধী উন্মাদের মতো যে সংখ্যার কথা বলেন, তার থেকে এই সংখ্যার বিস্তর ফারাক।’ একই সাক্ষাৎকারে ভুট্টো এমন কথাও বলেন, একাত্তরের হত্যাকাণ্ড ‘নৈতিকভাবে ন্যায়সংগত’ ছিল, পাকিস্তানের ঐক্য ধরে রাখতে এই সামরিক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল।
ভুট্টোর এই মিথ্যাচার সহ্য করা ফালাচির পক্ষে অসম্ভব ছিল। তিনি ভুট্টোর মুখের ওপর বলে বসেন, ‘না, মাননীয় প্রেসিডেন্ট। চল্লিশ নয়, আপনি বরং ১০ হাজার দিয়ে গুণ করুন, তাহলে হয়তো (ধর্ষিত নারীর) প্রকৃত সংখ্যার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন। মুজিব যদি যেমন–তেমনভাবে ৩০ লাখ মৃতের কথা বলে থাকেন, তাহলে বলতে হয় টিক্কা খান ৪ জন ধর্ষিতার কথা বলে পরিহাস করেছেন। বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, আর তা যে কী ভয়াবহ, আমি নিজে ঢাকার রাস্তায় লাশ দেখে তা বুঝেছি।’
ভুট্টোর ঔদ্ধত্য দেখে নিজের ক্রোধ সামাল দিতে পারেননি ফালাচি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বলেন, নৈতিকভাবে ন্যায়সংগত বলে একাত্তরের হত্যাকাণ্ডকে আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন, সেটি একটি ভয়াবহ অপচেষ্টা। ‘আপনাকে আমি ঠিক বুঝেছি তো? আপনি কি এ কথাই বলছেন যে (বাংলাদেশে) গণহত্যা নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায়?’
হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনেও ভুট্টোর কথারই প্রতিফলন রয়েছে। তারা শুধু যে সেই ৯ মাসে পাকিস্তানি হত্যাকাণ্ড লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছে তা–ই নয়। তারা এমন কথাও দাবি করে, আওয়ামী লীগের সদস্যদের হাতে যে পরিমাণ বিহারি মারা যায়, তাদের সংখ্যা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত বাঙালিদের চেয়েও বেশি। একটি বেসরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে কমিশন বলে, একাত্তরে বাঙালিদের হাতে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ বিহারি নিহত হয়।
একাত্তরের ইতিহাস বিকৃত করার যে অপচেষ্টা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক মহল ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে, ক্রমশ তা বিস্তৃত হয়। এখন তা কার্যত দেশটির সব পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এর একটা প্রমাণ মেলে পাকিস্তানের স্কুলে ব্যবহৃত পাঠ্যপুস্তক থেকে। এতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে সমর্থন করার পাশাপাশি পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার মূল দোষ চাপানো হয়ে থাকে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় ও ভারতের ওপর। কয়েক বছর আগে করাচির ডন পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকের ওপর একটি সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য দায়ী সেখানকার হিন্দু শিক্ষকেরা, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তান সম্বন্ধে বাঙালি ছাত্রদের মনে ভুল চিন্তা ঢুকিয়ে দেন। তার চেয়েও বড় দোষ ভারতের, যারা পাকিস্তানকে ভাগ করতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১ কোটি হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য। ডন পাকিস্তানের শিক্ষক উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধানের কথা উদ্ধৃত করে বলেছে, সেখানে যা শিক্ষা দেওয়া হয় তা মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। ‘আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের যা শেখাই তা একধরনের ধোঁকাবাজি।’
একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমার দাবি পাকিস্তান কখনোই আমলে নেয়নি। ১৯৭৪ সালে যে বাংলাদেশ- ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেছিলেন। জবাবে পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ বলেন, একাত্তরে যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, তার জন্য পাকিস্তান গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। সে ঘটনার পর একাধিক পাকিস্তানি নেতা দায়সারা গোছের ‘সরি’ বলে দায়িত্ব সেরেছেন। ১৯৭৪ সালে ভুট্টো ঢাকা সফরে গিয়ে একই কথা বলেছেন। ২০০২ সালে পারভেজ মোশাররফও ঢাকা সফরকালে দুঃখ প্রকাশ করে তাঁর বাংলাদেশি ভাইবোনদের ‘সামনে এগোনোর’ পরামর্শ দিয়ে যান। ২০১২ সালে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানিও বলেন, ‘দুঃখ তো প্রকাশ করেছি। আবার ক্ষমা চাওয়ার কী আছে?’
কিন্তু দুঃখ প্রকাশ আর ক্ষমা চাওয়া তো এক কথা নয়। দুঃখ প্রকাশের মধ্যে গণহত্যার জন্য দায় স্বীকারের কোনো ব্যাপার নেই। অন্যদিকে ক্ষমা চাওয়া একধরনের শুদ্ধীকরণ—যে অপরাধ করা হয়েছে তার জন্য একধরনের নৈতিক প্রায়শ্চিত্ত। কোনো জাতি যদি তার আত্মার নিরাময়ে আগ্রহী হয়, তাহলে এই ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়েই তা শুরু করতে হবে।
বিলম্বে হলেও পৃথিবীর অনেক দেশই তাদের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। ২০১০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের কাছে অধিগ্রহণকারী আমেরিকানদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে এক লিখিত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড তাদের দেশের আদিবাসীদের প্রতি অবিচারের জন্য যথাক্রমে ২০০৮ সালে ও ২০১৭ সালে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে। এমনকি গুয়াতেমালায় সামরিক সরকারের মানবিক অপরাধ সত্ত্বেও তাদের প্রতি সমর্থন জানানোয় সে দেশের আদিবাসীদের কাছে আমেরিকার পক্ষে ক্ষমা ভিক্ষা করেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন।
এই সব ক্ষমা চাওয়ায় আদিবাসী বা আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের আত্মার শান্তি আসবে না। সংঘটিত অপরাধের কোনো বিচারও মিলবে না। একই কথা বাংলাদেশের মানুষেরও। কী হবে পাকিস্তানের ক্ষমা দিয়ে? যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা তো আর ফিরে আসবেন না। আমরা সুবিচার পেয়েছি—এমন কথাও বলবেন না তাঁদের স্বজনেরা।
ক্ষমা দরকার পাকিস্তানের নিজের জন্য। তার আত্মশুদ্ধির জন্য। সে দেশের সরকার ও নেতারা গুরুতর অপরাধের জন্য দায়ী, তাঁদের অনেকে এখনো ওই সমাজে সম্মান নিয়ে চমৎকার দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের হাতে যে রক্তের দাগ আর চিত্তে যে কলুষ রয়ে গেছে, তা মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
সামনে এগোতে হলে এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি