পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে কি চাইবে না
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যে নৃশংসতা চালিয়েছিল, বাংলাদেশ তা ভুলে যেতে পারে না। একাত্তরের ঘটনাগুলো ভোলা যায় না। সেই ক্ষত চিরদিন রয়ে যাবে।
ওই সাক্ষাতের সময় হাইকমিশনার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেন। শেখ হাসিনাও তাঁর মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি দুই দেশের মধ্যে ফরেন অফিস কনস্যুলেশন সক্রিয় করতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালনকালে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। (প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০২০)
যে ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল, সেই ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী একাত্তরে তাদের গণহত্যা ও নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরলেন। পাকিস্তান সরকার এ সত্য প্রকাশ করতে বরাবর ভয় পায়। এখনো সেখানকার গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ জানে না, একাত্তরে বাংলাদেশে কী ভয়াবহ নৃশংসতা হয়েছিল। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো কথা নেই। পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে লেখা হয়, ভারতের ষড়যন্ত্রে ‘ঢাকার পতন’ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে পতন ঘটেছিল দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর দম্ভ ও অহমিকার।
এর আগে ১ জুলাই পাকিস্তানের হাইকমিশনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সাক্ষাৎকারের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি হাইকমিশনারকে বলেছি, একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়নি।’
স্বাধীনতার পর থেকে পরাজিত পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে থাকে। বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে। ১৯৭৪ সালে দুই দেশ পারস্পরিক স্বীকৃতি দিলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক হয় ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। আশির দশকে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠিত হলে দুই দেশের সম্পর্ক মোটামুটি স্বাভাবিক হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিলে পাকিস্তান নাক গলাতে থাকে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস করে। অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর বিষয়েও তারা একই ভূমিকা নেয়। এতে দুই দেশের সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে আসে। মুখে পাকিস্তান অতীত ভুলে যাওয়ার কথা বললেও নিজেরাই অতীতকে উসকে দেয়।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি হঠাৎ করে আসেনি। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ফেরত নেওয়ার আগে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭৪ নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচার করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা বাদ দিয়েছে। ছয় দিনব্যাপী জটিল আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে পাকিস্তানের সব যুদ্ধবন্দী তাদের দেশে ফিরে যাবে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে, পাকিস্তান সরকার তা স্বীকার করে নিল। তিন দেশের (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যকার চুক্তিতে আরও বলা হয় যে পাকিস্তান সরকার সংঘটিত অপরাধের নিন্দা ও গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের কাছে অতীতের ভুল ক্ষমা করা এবং ভুলে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। (নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ)
পাকিস্তানের এ অনড় অবস্থান সত্ত্বেও দেশটির অনেক প্রগতিশীল মানুষ মনে করেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখানে যে গণহত্যা চালিয়েছে, নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেছে, সে জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠক সম্পর্কে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, একপর্যায়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ নিবেদন করেন যে ঢাকায় বিচার শুরু হওয়ামাত্র পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়ে যাবে। তদন্ত সাপেক্ষে পাকিস্তানি দায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করারও আশ্বাস দেন তিনি (বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সন্ধানে, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা)
এরপর থেকেই পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া এবং পাওনা সম্পদ ফেরত দেওয়ার কথা বলে আসছে বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় অনেক বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করা হলেও পাকিস্তান এড়িয়ে গেছে।
২০০৯ সালের ১৫ মে পাকিস্তানি দূত আলীর বাশার খান সাক্ষাৎ করতে এলে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন। জবাবে পাকিস্তান জানায়, তারা ক্ষমা চাইবে না। (সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, ২৫ মে ২০০৯)
পাকিস্তানের এ অনড় অবস্থান সত্ত্বেও দেশটির অনেক প্রগতিশীল মানুষ মনে করেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখানে যে গণহত্যা চালিয়েছে, নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেছে, সে জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে যাঁরা প্রচারণা চালাতেন, তাঁদের একজন সাংবাদিক হামিদ মির। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সফরকালে তিনি প্রথম আলো অফিসে মতবিনিময়কালে বলেন, তিনি তাঁর দাবির পক্ষে চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তিনি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সই সংগ্রহ করছেন বলেও জানান।
হামিদ মির ঢাকায় আসার আগে ২০১১ সালের ২৩ মার্চ সাবেক ক্রিকেটার ও পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খানের একটি সাক্ষাৎকার নেন। জিও নিউজ ও জিও সুপার টিভিতে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইমরান খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হামিদ মির বলেছিলেন, আপনি কি দেখেননি ২৩ মার্চ ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের খেলায় বাংলাদেশি দর্শকেরা পাকিস্তানকেই সমর্থন করেছিলেন।
আপনি কি মনে করেন না সময় এসেছে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারের বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত? ইমরান খান সঞ্চালকের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ‘আমিও প্রথমে সেনা অভিযানকে ভালো পদক্ষেপ বলে মনে করেছিলাম।’ কিন্তু ওই সময়ে ইংল্যান্ডে গেলে তাঁর বাঙালি বন্ধুরা সেনা অভিযানে কী ঘটেছে, তা জানান। ইমরান খান ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, বাংলাদেশিরা তাঁকে ভালোবাসেন এবং স্নেহ করেন।
তিনি বলেন, ‘সেনা অভিযান পাকিস্তানের ভেতরে সব সময়ই ঘৃণা জাগিয়েছে। আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান খান বলেন, ‘অতীতের ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বেলুচিস্তান ও উপজাতীয় এলাকায় যে সেনা অভিযান চালানো হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়।’ এরপর হামিদ মির মন্তব্য করেছিলেন, পাকিস্তানে ইমরান খানই প্রথম বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি প্রকাশ্য টিভির অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেন।
এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২০১১ সালে। তখন তিনি ছিলেন বিরোধী দলে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ জয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ৯ বছর আগে যে দাবি তিনি করেছেন, সে দাবি পূরণের দায়িত্ব এখন তাঁরই। তিনি তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করবেন কি?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি