একটি সেতু নির্মিত হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি শুধু সেতু নিয়ে নয়, এর সঙ্গে একটি অঙ্গীকার ও স্বপ্নও বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করছেন। এই দিন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথপরিক্রমায় একটি বিশেষ দিন এবং জাতীয় আত্মমর্যাদার একটি ব্যতিক্রমী মাইলফলক। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাধা দূর হবে এবং একটি সমন্বিত ও একীভূত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচিত হবে, যা বাংলাদেশের শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত।
ত্রিমাত্রিক এ সেতুর বাস্তবায়ন-নকশা থেকে শুরু করে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, সেতু নির্মাণ, নদীশাসন ও দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ—অনেক দিক থেকেই পদ্মা সেতু পাইওনিয়ারের দাবিদার; বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সক্ষমতার দৃশ্যমান প্রতীক। নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ শুধু নয়, এ সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল বহুমাত্রিক ও বিভিন্নমুখী ঝুঁকি। ২০১২ সালে যখন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ১৩৩ বিলিয়ন ডলার, এখনকার তুলনায় এক-তৃতীয়াংশের কম। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার, বর্তমানের এক-চতুর্থাংশ, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রার আয় ছিল এখনকার তুলনায় অর্ধেকের কম। নিজস্ব তত্ত্বাবধানে প্রমত্ত পদ্মাকে শৃঙ্খলে আনার কারিগরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টা ছিল অভূতপূর্ব। এ ধরনের মাপের বড় প্রকল্পের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ছিল প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতি। প্রধানমন্ত্রী এসব ঝুঁকিকে বিবেচনায় রেখেই নিজস্ব অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ সেতুর নির্মাণের সঙ্গে সারা দেশের মানুষের যে স্বপ্ন জড়িয়ে ছিল, তা নিশ্চয়ই তাঁর আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়কে বাড়তি শক্তি জুগিয়েছিল।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, আমাদের প্রকৌশলী, উপকরণ সরবরাহকারী, শ্রমিক, ব্যবস্থাপক আর স্থানীয় ও বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানসমূহের নিরলস কর্মকাণ্ডের ফসল এ সেতু। বদ্বীপ বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি পরিবর্তনশীল, নদীর গতিপথ অস্থির, নদীর তলদেশ অস্থিতিশীল। একটি জটিল ও দুরূহ পরীক্ষা তাঁরা সম্মিলিত উদ্যোগে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের অবদান পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর অবদান নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আগেই শুরু হয়ে গেছে। সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্মাণসামগ্রীর সরবরাহের একটি বড় অংশ আমাদের স্থানীয় উৎপাদক ও সরবরাহকারীরাই করেছেন। সেতুর জন্য ৭ দশমিক ৫ লাখ টন সিমেন্ট আর ২ দশমিক ২ লাখ টন ইস্পাত স্থানীয় প্রস্তুতকারকেরাই সরবরাহ করেছেন, যা শ্রম নিয়োজনের বাড়তি সুযোগ করেছে এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে; বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ—এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে আপাত দৃশ্যমান নয় কিন্তু ইতিবাচক আরেকটি দিক হলো, এ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অর্জিত মানবপুঁজি। এই বিশাল ও জটিল প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বড় অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় আমাদের যে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে, সে মানবসম্পদের মূল্যায়ন টাকায় পরিমাপ করা কঠিন। এ প্রযুক্তি-জ্ঞান-অভিজ্ঞতা লব্ধ পুঁজি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ, যার ইতিবাচক ফল থেকে অর্থনীতি লাভবান হবে পরবর্তী বহু বছর ধরে।
এ সেতু নিয়ে যে প্রাথমিক সমীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে প্রাক্কলন করা হয়েছিল যে অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুণক ইতিবাচক প্রভাবে দেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তি সংযোজন হবে। রেল সংযোগের কারণে জিডিপিতে যুক্ত হবে আরও ১ দশমিক শূন্য শতাংশ। নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত হওয়ার কারণে যানবাহন পারাপার বর্তমানের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে। কর্মসংস্থান হবে সাড়ে সাত লাখ মানুষের। সে অর্থে ৪৩০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপিতে ১০ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত যোগ হবে, যা গুণক আকারে বাড়বে। এ অবদান আসবে সেতু ও সড়কের সুবিধা নিয়ে যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে, পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হবে, সময় সাশ্রয়ী ও ব্যয়সাশ্রয়ী পরিবহন হবে, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে তার সুবাদে। টোল আদায়ের বাইরে এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে কর ও করবহির্ভূত সম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদেই হবে দেশের অর্থনীতিতে এ সেতুর অবদান। এসব সম্ভাবনার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে এসব বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে সেতু থেকে সড়ক করিডর ও সড়ক করিডর থেকে অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তর অভিমুখী নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
শুধু দ্রুততর যোগাযোগ, বিতরণ ও বিপণনের সুবিধার কারণে নয়, পদ্মা সেতু করিডরের উভয় পাশে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব। ইতিমধ্যে সেতুকে ঘিরে অ্যাপ্রোচ রোডের দুধারে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা স্থাপনার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান হচ্ছে। সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় ১৭টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার ও একাধিক শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। শুধু স্থানীয় বাজারমুখী নয়, রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপও অনেক উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে গ্রহণ করছেন। এতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নতি হবে, বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পণ্য ও সেবার সহজ চলাচলের কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, রপ্তানিকারক, সেবা খাতকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আহরণের নতুন নতুন সুযোগ ও ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।
আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে; বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ—এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু। যোগাযোগ সংযোগ, বিনিয়োগ সংযোগ ও বাণিজ্য সংযোগ—এই ত্রিমুখী সংযোগের সার্থক সমন্বয় করতে সক্ষম হলে পদ্মা সেতু হবে অর্থনৈতিক করিডরের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
বিবিএসের হিসাবমতো, দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার ১৩টির ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের অংশ বাংলাদেশের গড়ের চেয়ে বেশি; এসব অঞ্চল থেকে বিদেশি শ্রমবাজারে অংশগ্রহণও তুলনামূলকভাবে কম। সেতুকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসৃজন যেমন সৃষ্টি করতে পারবে, তেমনি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের অংশগ্রহণের বাড়তি সুযোগও সৃষ্টি করবে। এসব সুযোগ বাস্তবায়িত করতে হলে এ অঞ্চলে প্রযুক্তি বিস্তার ও প্রশিক্ষণের প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পদ্মা সেতুর এসব ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করতে হলে সমন্বিতভাবে বিনিয়োগ কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবে। সময়মতো, সাশ্রয়ীভাবে ও সুশাসনের সঙ্গে এসব সমান্তরাল উদ্যোগের বাস্তবায়ন ইকোনমিক করিডরের ইতিবাচক অবদানে দেশকে সমৃদ্ধতর করবে। এর জন্য বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, ওয়ান-স্টপ অ্যাক্ট ২০১৮-এর আলোকে সিঙ্গেল-উইন্ডো সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও দেশীয় বিনিয়োগ আহরণে উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রণোদনা কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন হবে। বাণিজ্য সহজীকরণ, প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমিক ও পেশাদার মানুষদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীশাসন, সেতুর ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা বিধান হবে একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে অর্থায়নের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
এটাও নিশ্চিত করা জরুরি যে যানবাহন যেন পদ্মা সেতু ও ঢাকা-মাওয়া দ্রুতগতির মহাসড়ক পেরিয়ে ঢাকা নগরে প্রবেশের সময় বড় ধরনের যানজটে না পড়ে। যেসব যানবাহন অন্যত্র যাবে, তারাও যেন ঢাকা নগরকে পাশ কাটিয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে পারে। এটা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনামাফিক ঢাকার অভ্যন্তরীণ চক্রাকার সড়ক ও পূর্বাঞ্চলীয় বাইপাসের নির্মাণকাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। পদ্মা সেতু থেকে প্রত্যাশিত আর্থিক ও অর্থনৈতিক রিটার্ন নিশ্চিত করতে হলে এসব উদ্যোগ দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। সমান্তরাল উদ্যোগগুলোর সার্থক বাস্তবায়ন প্রত্যাশিত ইতিবাচক অর্জনসমূহকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১’-এ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের যে অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক সুযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে সে অভীষ্ট বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
মোস্তাফিজুর রহমান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো