নারায়ণগঞ্জের শিক্ষা কি রাজনৈতিক দলগুলো নেবে

পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো কোনো দেশ আমাদের দেশের আইনের শাসন, মানবাধিকার, নির্বাচন বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো ইস্যু নিয়ে চাপ তৈরি করছে। যদিও খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ এবং শ্বেতাঙ্গ–অধ্যুষিত উন্নত বিশ্বে বর্ণবাদের প্রকট ও প্রচ্ছন্ন উপস্থিতিও অনস্বীকার্য, তবু তাদের সঙ্গে বহুকালের দাতা-খাতকের সম্পর্কের কারণে যেমন, তেমনি এসব অভিযোগের কিছু ভিত্তি থাকার ফলে বাংলাদেশ যেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পাল্টা বক্তব্য দিতে পারছে না। তবে বাংলাদেশের জন্য আমাদের বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সেই সংস্কৃতিকে শক্তিশালী হতে দেওয়াই হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান উজ্জ্বল ও দৃঢ় করার সহজ পথ। মনে হয় সময়ক্ষেপণ না করে সেই পথের সন্ধান ও তা অনুসরণ করাই হবে সর্বোত্তম কাজ।

সেদিক থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচন পথের সন্ধানীদের জন্য চোখ খুলে দেওয়ার কাজ করতে পারে। পঁচাত্তরের পর থেকে এরশাদের পতন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে আওয়ামী লীগের জন্য সঠিক রাজনীতির চর্চাই ছিল কঠিন। এই সময়ে ক্ষমতার যোগসাজশে এবং নতুন দলের শক্তিবৃদ্ধির তৎপরতায় রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র এবং ক্যাডার বাহিনীর সংযোজন ঘটে। টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্রমে আওয়ামী লীগেও এই সংক্রমণ ঘটেছে। ফলে দেশের নানা অঞ্চলে এক জাতের ওয়ার লর্ড বা আউট-ল রাজনীতিক তৈরি হয় বড় দুই দল ও জাতীয় পার্টিতে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ১৯৭৭-১৯৯৫ দেড় যুগ সময়ে এরা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে—বৈধতার চ্যালেঞ্জ কেউ তাদের জানায়নি। বরং এরা নির্বাচনের ফলাফল নিজ নিজ পক্ষে আনার কাজে সফল হয়েছে। এভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ এবং অবৈধ কাজ ও সম্পদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পরে জনমনে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পক্ষে প্রত্যাশা জেগেছিল। কিন্তু রাজনীতিকেরা পুরোনো পথে হাঁটা বাদ দিতে ও কঠিন সময়ের ‘বান্ধবদের’ ছাড়তে পারেননি। দেখা যাচ্ছে ’৯১-পরবর্তী আমলে নতুন প্রজন্মের প্রতাপশালী রাজনীতিকেরা সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈধতার অন্বেষণ করেছেন এবং প্রায় ক্ষেত্রে পেয়েও গেছেন। নব্য ধনিকশ্রেণি থেকেও অনেকে রাজনীতি তথা ক্ষমতার অঙ্গনে এসেছেন। এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদেরই আধিক্য—এদের প্রধান নির্ভর অর্থ, অর্থের কারণে ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ক্যাডার পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নানা স্তরে সম্পর্ক স্থাপন তাদের স্বাভাবিক কৃত্য। এ পথে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা যেমন ক্রমেই কানাগলিতে আটকে যাচ্ছে, তেমনি নির্বাচনের ফলাফল নিজের পক্ষে রাখার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারও সহজে বন্ধ হবে না। দেশে এই আলামতই আমরা দেখতে পাচ্ছি।

পেশিশক্তি বা কালোটাকা এখনো রাজনীতিতে রয়েছে। তার ওপর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্রমেই আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। তাদের ছায়ায় থেকে একশ্রেণির রাজনীতিকের ক্ষমতার অপব্যবহারও বাড়ছে, যা ছোটখাটো আমলাদের শারীরিক লাঞ্ছনা থেকে নদী-ভূমি দখল পর্যন্ত গড়াতে দেখা যাচ্ছে। রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে এসব উটকো ঝামেলা।

এই ধারার বাইরে থেকে নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভী সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বলে নেওয়া প্রয়োজন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কৃতিত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়, আইভীর এবং সেই সঙ্গে তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর আলমেরও। আইভী তিনবার করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচন থেকে কী শিক্ষা পাওয়া গেল? পরিস্থিতি পাল্টেছে, মানুষের কাছে সেই প্রার্থীই গ্রহণযোগ্য, যাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, কৌশল স্বচ্ছ এবং ভূমিকা সরলভাবেই জনবান্ধব। আইভী তাঁর সবল সারল্য, ভোটারদের ওপর আন্তরিক আস্থা এবং রাজনীতিতে বিশ্বস্ততার স্বাক্ষর রেখেই সবার মন জয় করেছেন।

এ দৃষ্টান্তের আলোকে এখন এ কথা বলা যায় যে মানুষকে সুযোগ দিলে তারা রাজনীতির সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারে। সে জন্য চাই সঠিক প্রার্থী এবং যথার্থ প্রচারণা। বর্তমান সরকার গত এক যুগে যত কাজ করেছে, এমনটা কোনো সরকার করতে পারেনি। এ কেবল সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফল নয়, এতে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, সাহস এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কথাও বলতে হবে।

সম্ভবত নির্বাচন নিয়ে সরকার কখনো নিশ্চিত হতে পারেনি—অতিরিক্ত সতর্কতা কিংবা দলের বিভিন্ন স্তরে নার্ভাসনেস থাকার কারণে ক্ষমতার হস্তক্ষেপ কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো ধারায় নির্বাচন বৈতরণি পার হওয়ার কৌশল ছাড়তে চায়নি কেউ। এটি চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনে—সম্ভবত দলীয় প্রধান ও অনেক নেতার ভাবনাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল সরকারি ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের মাত্রা। কিন্তু আমার ধারণা, এর প্রয়োজনই হতো না যদি ২০১৩ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতো। কারণ, সেবার ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকত। হয়তো জয়ের ব্যবধান খুব বড় হতো না। এতে সরকারি দলের মধ্যে যে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস থাকত, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারত। তখন সুষ্ঠু নির্বাচনের এই ভাবমূর্তি ও আত্মবিশ্বাসের জোরে ২০১৮ সালেও নির্বাচন ভালো করা সম্ভব ছিল।

আমরা আশা করব, দেশের সব রাজনৈতিক দলই ২০২৩ সালের নির্বাচনে অংশ নেবে এবং রাজনীতিকে নীতিমান, দায়বদ্ধ, জনদরদি মানুষের চর্চার বিষয় করার সুবিধাটা উপলব্ধি করবে। ভবিষ্যতের জন্য এই বারতাই দিতে হবে যে পেশিশক্তি, অবৈধ টাকা, ক্ষমতার অপব্যবহারের দিন শেষ হতে চলেছে, নতুন দিনের সূচনা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে।

পেশিশক্তি বা কালোটাকা এখনো রাজনীতিতে রয়েছে। তার ওপর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্রমেই আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। তাদের ছায়ায় থেকে একশ্রেণির রাজনীতিকের ক্ষমতার অপব্যবহারও বাড়ছে, যা ছোটখাটো আমলাদের শারীরিক লাঞ্ছনা থেকে নদী-ভূমি দখল পর্যন্ত গড়াতে দেখা যাচ্ছে। রাজনীতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে এসব উটকো ঝামেলা। আমাদের আজ বলার কথা হলো, দেশের রাজনীতি এবং গণতন্ত্রচর্চাকে স্বচ্ছ ও সৎ জায়গায় আনার সুযোগ রয়েছে। তাই বলব, আর অপেক্ষা না করে নারায়ণগঞ্জের নিরীক্ষা অন্যত্রও প্রয়োগ করা দরকার। রাজনীতিতে, নির্বাচনে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষদের সামনে আনতে হবে। সাধারণ মানুষ এখনো মানুষই আছে, অর্থাৎ তাদের মানবিক আচরণের সুযোগ দিলে তারা তা-ই করে।

এ কথা ঠিক, তৈমুর আলম খন্দকারও প্রায় এক লাখ ভোট পেয়েছেন। মনে রাখতে হবে, তৈমুর আওয়ামী লীগবিরোধী সব ভোট পেয়েছেন। তদুপরি স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে যে বিভাজন ছিল, তারও ভূমিকা এতে থাকতে পারে। তবে বলতেই হবে, তৈমুর আলম খন্দকারও নির্বাচনে তাঁর স্বচ্ছতা এবং সৌজন্য বজায় রেখেছেন, কোথাও সীমা লঙ্ঘন করেছেন বলে শোনা যায়নি। আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তাঁরও ভালো ভোট পাওয়া ন্যায্য ব্যাপার ছিল। বলা যায়, নারায়ণগঞ্জে অন্যায্য কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা আশা করব, দেশের সব রাজনৈতিক দলই ২০২৩ সালের নির্বাচনে অংশ নেবে এবং রাজনীতিকে নীতিমান, দায়বদ্ধ, জনদরদি মানুষের চর্চার বিষয় করার সুবিধাটা উপলব্ধি করবে। ভবিষ্যতের জন্য এই বারতাই দিতে হবে যে পেশিশক্তি, অবৈধ টাকা, ক্ষমতার অপব্যবহারের দিন শেষ হতে চলেছে, নতুন দিনের সূচনা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। সময় যে খুব বেশি আছে তা নয়, এখন থেকে প্রার্থী বাছাই শুরু করা দরকার। কারণ, সম্ভাব্য প্রার্থীদের তো মাঠে নিজেদের গুছিয়ে নিতে হবে, তাঁরা তো আর টাকা, পেশি, ক্ষমতার যোগসাজশে নির্বাচন করবেন না।

স্থানীয় সরকারের ছয় ধাপের দীর্ঘ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ভালো করেছে বলা যাবে না, তাদের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার রোগ বেড়েছে বরং। আর তার জেরে শেষ পর্বটি ছাড়া প্রতিটিতে খুনোখুনি হয়েছে বেশি। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এ নির্বাচনে যোগ না দিলেও তাদের প্রার্থীরা (হয়তো এঁরাও বিদ্রোহী) সেদিক থেকে খারাপ করেননি। সব মিলিয়ে এ নির্বাচনগুলোও একই বার্তা দিয়েছে। বার্তাটি রাজনৈতিক দলগুলো বুঝলে হয়।

মোট কথা, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলকে প্রথা ভাঙার সাহসের এবং সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগ এবারে এই পরিচয় দিতে এগিয়ে আসবে। তবে বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে আনতে হলে অনুসন্ধান কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কে বা কারা যুক্ত হচ্ছেন, তা হবে গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনকে এবার হুকুমের নয়, আইনের মুখাপেক্ষী হয়ে চলতে হবে। কেননা লেখার প্রথমে পশ্চিমা বিশ্বের সাম্প্রতিক যেসব তৎপরতার কথা বলেছি, তাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন একটি বড় চাহিদা থাকবে। এটি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশেও বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক