সাম্প্রতিক কালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১৯৭৮ সালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী এ দেশে এসেছিল। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের যে ঢল এ দেশে এসেছে, এমনটা আগে কখনো হয়নি। এটা দেশের জন্য বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নানা নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেটার আশু সমাধান দরকার। শরণার্থীদের আগমন মানবিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আন্তরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মানবিক নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং মানব পাচারসংক্রান্ত নিরাপত্তার ঝুঁকি প্রধান বলে প্রতীয়মান হয়। কিছু সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানবপাচারচক্র রোহিঙ্গাদের প্রতি শকুনের দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। বেশির ভাগ আগত রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে কোনো পুরুষ সদস্য নেই, অধিকাংশই নারী ও শিশু। ফলে বিভিন্ন পাচারচক্র তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের বিদেশে যৌনকর্মী এবং শিশুশ্রমিক হিসেবে পাচার করার চেষ্টা করতে পারে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী খাদ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে খাদ্যের সহায়তা আসছে। কিন্তু তা শরণার্থীদের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে খাদ্যের অভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শিশুরা অপুষ্টি এমনকি অকালমৃত্যুর শিকার হতে পারে। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে এ বছর বন্যার কারণে ইতিমধ্যে প্রচুর খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। তদুপরি রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংস্থানের চাপ যোগ হয়ে তা বাংলাদেশের খাদ্য মজুতেরও নতুন সংকট তৈরি করছে, যেটা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে ধরা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টাও উদ্বেগের কারণ। স্থাপিত ক্যাম্পে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে আগত শরণার্থীরা খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছে। তাদের জন্য ন্যূনতম স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। এর ফলে মানুষবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। আগত রোহিঙ্গাদের কোনো স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা করা হয়নি। রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের অনেকে যক্ষ্মা, চর্মরোগ ও এইচআইভির জীবাণু বয়ে নিয়ে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে রোগগুলো বাংলাদেশিদের মধ্যেও সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যে স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে, তা বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। নিরাপদ খাওয়ার পানির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের হাইতি ও ইয়েমেনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মনে রাখতে হবে। শরণার্থী সংকটের ফলে স্থানীয় মানুষের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আমরা জানি, শ্রমবাজার শ্রমিকের চাহিদা ও জোগানের মিথস্ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। অতিরিক্ত রোহিঙ্গা শ্রমিকের উপস্থিতি এই স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে। প্রচুর শ্রমের জোগানের ফলে শ্রমমূল্য কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যার ফলে স্থানীয় শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে ক্যাম্পের আশপাশের লোকজনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রতি ক্ষোভ জন্মাতে পারে, যা স্থানীয় শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। যদিও সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্প থেকে বের হওয়া আইনত নিষেধ করেছে, কিন্তু এটা কার্যকর করা দুরূহ হবে। এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে প্রান্তিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মৌলিক মানবাধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের পক্ষে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া খুবই সহজ। তাদের মানসিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো মহল তাদের জঙ্গিবাদের দিকে প্ররোচিত করতে পারে। তা ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জনসাধারণ এখন বেশ সোচ্চার হয়ে আছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার তাদের ক্রুদ্ধ করে তুলছে। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের উগ্র মতাদর্শের দিকে ধাবিত করতে পারে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং তাদের উপাসনালয়ের ওপর হামলার আশঙ্কা নাকচ করে দেওয়া যায় না।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পাশাপাশি এ অঞ্চলে বহুজাতিক নিরাপত্তাঝুঁকিও রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’-এর মাঝে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ মাদক পাচারের একটা আদর্শ রুট। একইভাবে এই অঞ্চল ক্ষুদ্রাস্ত্র পাচারের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চক্র প্রান্তিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মাদক ও ক্ষুদ্রাস্ত্র পাচারের বাহক হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে। আশঙ্কা রয়েছে স্থানীয় নতুন মাদকচক্র এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে ওঠার। এর ফলে মাদক ও অস্ত্র আরও সহজলভ্য হয়ে উঠবে, যা আন্তরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে উপজীব্য করে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন করে তৎপর হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিভিন্ন ছবি, ভিডিও ইন্টারনেটে শেয়ার করে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো মুসলিম তরুণদের উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদা ইতিমধ্যে মুসলিমদের জিহাদের ডাক দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার ডানপন্থী ইসলামিক সংগঠন ফ্রন্ট পেমবেলা ইসলাম (এফপিআই) মিয়ানমারে জিহাদ করার জন্য ১ হাজার ২০০ যোদ্ধার রেজিস্ট্রেশন শুরু করেছে। চেচনিয়ার বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠীকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহযোদ্ধা হয়ে জিহাদে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ইতিমধ্যে আইএস মধ্যপ্রাচ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক জঙ্গির কাছে রাখাইন জিহাদের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) সংগঠিত হয়েছে, তারা সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিয়েছে। জানা যাচ্ছে, ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের পুলিশ ফাঁড়ি এবং সেনাছাউনিতে এই গোষ্ঠী আক্রমণ করেছিল। তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও অর্থ সংগ্রহের বন্দোবস্ত রয়েছে। সংগঠনটি বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা রাখাইন রাজ্য আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যেটা আমাদের নিরাপত্তার জন্য একটা বড় ধরনের হুমকি।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৭০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ইতিপূর্বে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে জল ও স্থলসীমান্তে অস্থিরতা ও সংঘাতপূর্ণ পরিবেশের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। সে সময়ে মিয়ানমার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করেছিল। এর ফলে দুই দেশের নৌযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিছুদিন ধরে মিয়ানমারের উড়োজাহাজ কর্তৃক বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। সরকারিভাবে জোরালো প্রতিবাদ করা হলেও মিয়ানমার এতে কর্ণপাত করেনি। ইদানীং বিভিন্ন সূত্র থেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের সেনা মোতায়েনের খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ। এসব অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বলা যায়, বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছে। ভূ–প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পুরোপুরি সিলগালা করে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ভবিষ্যতে মিয়ানমারে সহিংসতা চলতে থাকলে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকবে, যেটা দুই দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে মিয়ানমারের তরফ থেকে কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ আমাদের সীমান্তের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে।
বাংলাদেশে আসা মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ৮ লাখ ছাড়িয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য নির্ধারিত ক্যাম্পগুলোর ধারণক্ষমতা খুবই সীমিত। ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্পের বাইরে কাছাকাছি পাহাড়গুলোতে জায়গা করে নিয়েছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে যে পাহাড় ও জঙ্গল কেটে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করছে। এতে করে পাহাড়ধসের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এতে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বর্তমান অপরিকল্পিত অবস্থানের কারণে সেটা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের মিত্র দেশগুলো নতুন অবস্থান নিচ্ছে। বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও চীন মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়েছে। বৃহৎ রাষ্ট্র দুটির মিয়ানমারে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। দেশটিতে প্রভাব ধরে রাখার জন্য উভয় দেশ মরিয়া চেষ্টা করে চলেছে। রাশিয়াও একই রকম অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে তিনটি দেশই আগ্রহী, যা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে, যা আমাদের কূটনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
রোহিঙ্গা সমস্যা খুবই জটিল। বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে আগমন এ দেশের সীমিত সম্পদের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জন্য সমস্যাটা বেশি প্রকট হয়ে উঠছে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে। বাংলাদেশকে অবশ্যই একটা সমন্বিত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য একটা সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। অন্যথায়, বিদ্যমান অবস্থা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
আ ন ম মুনীরুজজামান: ঢাকায় অবস্থিত নিরাপত্তা চিন্তাশালা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি।