আমার এবং আমার আইনগত অভিভাবকত্বে থাকা নাবালক মেয়ের পুরোনো এমআরপি পাসপোর্ট দুটি ই-পাসপোর্টে নবায়ন করার জন্য অনলাইনে ফরম পূরণ করলাম। এক্সপ্রেস তথা দ্রুত ‘ডেলিভারি সার্ভিস’ চেয়ে সাক্ষাৎকার বা অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ চাইলাম। প্রায় দেড় মাস পরের একটা তারিখ পেলাম।তারপর ঢাকা ব্যাংকে দুটি আবেদনের জন্য মোট ১৬ হাজার ৬৫০ টাকা এক্সপ্রেস ফি জমা দিলাম। নির্ধারিত তারিখে ১৭ মে সকাল সাড়ে নয়টায় আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে চাহিদামতো কাগজপত্র নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম।
অনলাইনে দেওয়া চাহিদা তালিকায় লেখা ছিল, পূর্ণ আবেদনপত্রের ছাপা কপি আনা ঐচ্ছিক। আমরা সেগুলো নিইনি। প্রথম ডেস্কে পৌঁছানোর পর বলা হলো, সেগুলো লাগবেই। ফিরে গিয়ে সেগুলো প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বেলা সাড়ে এগারোটার বেশি হলো।
এ যাত্রা প্রথম ডেস্কে পৌঁছালে কাগজপত্রে ছাপ্পড় মেরে বলা হলো নারীজাতিকে ৪০১ কক্ষে পরবর্তী কাজ করাতে হবে। আমার বয়স ষাট হতে যাচ্ছে। হাঁটুর হাড়ক্ষয়ের কারণে লেংচে চলি। সিঁড়ি ভাঙা বারণ, কিন্তু দেখি পাঁচতলা পর্যন্ত লিফটে ওঠা যাবে না। তখন হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করে সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠলাম। জেনানামহলে (নারী ও শিশু কর্নার) গিজগিজে ভিড়। এক ধারের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ৪০১-এ ঢুকলাম। এলোমেলো হাতে কাগজপত্র বের করলাম। ফটোকপি ও আসল কাগজপত্র চেক করার পর এক কর্মকর্তা ছাপ্পড় মেরে বললেন ৪০৫ নম্বর ঘরে গিয়ে ছবি তোলাতে।
দুই ঘরের মধ্যখানের করিডরে সর্পিল লাইন। যেন বিচিত্র এক সাপলুডো বোর্ড। এক ধারের একটা লাইন যাচ্ছে ৪০১ নম্বরে। মাঝে একটা লাইনের গোড়ায় দাঁড়িয়ে তিন পাক ঘুরে ঘুরে তারপর ৪০৫-এর দরজায় যেতে হবে। ততক্ষণে সেখানে দু-তিন শ নানা বয়সী নারী দাঁড়িয়ে গেছেন। আমার মতো বেশ কয়েকজন প্রবীণা বহু কষ্টে লাইন ধরে পিঁপড়ার মতো এগোচ্ছেন। একপর্যায়ে দু-একজন মাটিতে বসে পড়ে ছেঁচড়ে চলতে লাগলেন। একজন পূর্ণগর্ভা নারীকেও এই ‘পুলসিরাতের’ লাইন ধরতে দেখলাম। বসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
দেয়ালের লেখা বলছে নিরাপদ দূরত্ব—অন্তত তিন ফুট—বজায় রাখতে। গরু-ছাগলের পালের মতো আমাদের দাঁড়াতে হয়েছে পরস্পরের পিঠে নাক ঘষা দূরত্বে। ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটার কাছাকাছি। ছবি তোলার জন্য ৪০৫ নম্বর ঘরে ঢুকতে বেলা সাড়ে তিনটার বেশি বেজে গেল। ভেতরেও লাইন। ততক্ষণে আমার দুই হাঁটু জবাব দিয়েছে। একরকম হুমকি দিয়ে কোনার টেবিলের কাছে একটা চেয়ারে বসার সুযোগ আদায় করলাম। একটু পর আরেকজন প্রবীণাকে চেয়ারটা ছেড়ে দিলাম। তাঁর পায়ে দুর্ঘটনাজনিত বেশ কয়েকটা অপারেশন আছে।
কোনার টেবিলে সেবাদানকারী নারী কর্মকর্তাটি অনবরত কাশছেন। তাঁর মাস্ক গলায় ঝুলছে। কাশতে গিয়ে তিনি মুখের সামনে হাত ধরছেন। পরক্ষণেই সেই হাতে আমাদের কাগজপত্র ধরছেন, আমাদের আঙুল ধরে স্ক্যানারে চেপে দিচ্ছেন। তাঁকে বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন মাস্কটা মুখে পরে নেন। তিনি বললেন, তাঁর ঠান্ডা লাগার কাশি; ভয়ের কিছু নাই। আবারও অনুরোধ করলে বললেন, ‘দেশে এখন করোনা আছে না কি?’ মাস্ক ঝুলন্তই রইল।
মেয়ের দুর্ভোগ
পালা এলে আমি তাঁর সামনে বসলাম। আমার মেয়েকে পেছনের একটা টেবিলে ডাকা হলো। এখানে দুটি কথা আছে। আত্মার সম্পর্কে আমি তার মা, সে আমার মেয়ে। তবে দাপ্তরিক দুনিয়ার কাছে আমি আদালতের দ্বারা নিযুক্ত তার আইনি অভিভাবকমাত্র। মুসলিম পারিবারিক আইনে দত্তক নেওয়ার বিধান নাই। আমি তাই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজপত্রে তার ‘মা’ পরিচয় দিতে পারি না।
এই সংসারে সবার জৈবিক পিতৃপরিচয় জানা থাকে না, মায়ের জৈবিক পরিচয়েও জটিলতা থাকে। আমার কন্যার জন্মনিবন্ধন সনদে পিতা ও মাতার নামের ঘরে ‘নট অ্যাভেইলেবল’ লেখা।
আমি তার আইনি অভিভাবক হয়েছি পারিবারিক আদালতের আদেশে। এই আদেশ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খতিয়ে দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ আমাকে তার পাসপোর্ট করানোর ব্যাপারে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেয়। এসব কাগজপত্রের ভিত্তিতে তার প্রথম পাসপোর্টটি হয়। সেটাতে অতিরিক্ত তথ্যের মধ্যে অভিভাবক হিসেবে আমার নাম আছে; মা-বাবার কোনো উল্লেখ নেই।
তার এবারকার আবেদনপত্রের সঙ্গে এসব কাগজপত্রের ফটোকপি জমা দিয়েছি, আসল কাগজগুলোও সঙ্গে রেখেছি। আমার কাজের মাঝপথে মাস্ক-খোলা কর্মকর্তা আমাকে বললেন, মেয়ের ঝামেলা মিটিয়ে আসতে। কানে এল, সেই টেবিলের সেবাদানকারী নারী কর্মকর্তা আমার মেয়েকে প্রশ্ন করছেন, মা-বাবার নাম নেই কেন, তাদের পরিচয় কী ইত্যাদি।
আমার মেয়ে শুনলাম বলছে, জানা নাই, সে কথা জন্মনিবন্ধন সনদেও আছে। তবু তিনি এ প্রশ্ন করেই চলেছেন। আমি গিয়ে বললাম, সনদে আছে মাতা-পিতার পরিচয় অপ্রাপ্য। এর বেশি তাঁর জানার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এনওসি দেখলেন, পারিবারিক আদালতের আদেশ দেখলেন, মেয়ের প্রথম পাসপোর্ট দেখলেন। কিন্তু তাঁর সন্দেহ বা কৌতূহল কিছুতেই তৃপ্ত হচ্ছে না। তিনি বললেন, জন্মস্থান লেখা আছে ঢাকা। আমাকে এবং মেয়েকে প্রশ্ন করতে লাগলেন, তথ্যটি সঠিক কি না। তারপর মেয়েকে বললেন, দেখে মনে হচ্ছে না তার জন্ম ঢাকায়।
হঠাৎ আরেক টেবিল থেকে এক যুবক কর্মকর্তা আমাকে ধমক দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, আমি তখন থেকে বাধা দিচ্ছি। যেকোনো প্রশ্ন করার অধিকার তাঁদের আছে। আমি জবাব দিতে বাধ্য।
আমি তখন বিধ্বস্ত, বিরক্ত। বললাম, কাগজপত্রের বাইরে ‘মনে হওয়ার’ কোনো স্থান নাই। তবে তাঁর কাছ থেকে মুখ দেখে জন্মস্থান জানার বিদ্যাটা শিখে নিইনি বলে এখন আফসোস হচ্ছে। যা-ই হোক। হঠাৎ আরেক টেবিল থেকে এক যুবক কর্মকর্তা আমাকে ধমক দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, আমি তখন থেকে বাধা দিচ্ছি। যেকোনো প্রশ্ন করার অধিকার তাঁদের আছে। আমি জবাব দিতে বাধ্য। বললাম, কাগজপত্র যা দিয়েছি, সেখানে যে উত্তর আছে, তার বাইরে আমি কিছু কেন কীভাবে বলব, তাঁরাই বা কেন সেসব প্রশ্ন করবেন।
নারী কর্মকর্তাটি রূঢ় গলায় বললেন, পুরোনো পাসপোর্টে পিতার নামের জায়গায় ভুলভাবে আমার নাম দেওয়া আছে। আমি পাসপোর্ট খুলে তাঁকে দেখালাম, সেখানে আমার নাম আছে অভিভাবক হিসেবে। তখন তিনি বললেন, ডেটাবেইজ নাকি আমাকে পিতা দেখানো আছে।
অত্যন্ত ত্যক্ত-বিরক্তিতে আমাদের কাজ শেষ হলো, ডেলিভারি স্লিপ পেলাম। বাইরে তখনো কয়েক শ নারীর ভিড়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে কর্মকর্তাদের ওপর কাজের চাপ খুব বেশি। কিন্তু কিছুটা তমিজ, অন্তত শিশুকে প্রশ্ন করার বিষয়ে সংবেদনশীলতা তো তাঁদের শিখতে হবে।
কর্মকর্তাদের নামগুলো প্রকাশ করছি না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সহজেই তা জানতে পারবে। অবশ্য এসব বিষয়ে তাদের কিছু প্রশিক্ষণ দেবে কি না, আমি নিশ্চিত নই। আর সর্বসাধারণকে দিনভর গরু-ছাগলের পালের মতো ঠেলেঠুলে ভোগান্তি করা হবে না, তাদের বসার ব্যবস্থা থাকবে, ছবি তোলার ডেস্ক বাড়ানো হবে—সেসব আশা তো মোটেই হচ্ছে না।
আমরা নিচে ১০১ কক্ষটি দেখতে গেলাম, যেখানে নাকি প্রবীণ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের কাজ করার কথা। সেখান থেকে একজন অসুস্থ প্রবীণাকে চারতলায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। গার্ড বললেন, সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করা হয়। ষাটোর্ধ্ব ও অসুস্থ ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রশ্ন করলে দুর্বল সুরে বললেন, সেটাও হয়।
ফেরার পথে ডেলিভারি স্লিপগুলো আবারও খুঁটিয়ে দেখলাম। আমাদের খাসা ছবি উঠেছে! আমার আধা পাকা উড়া ধুরা চুলে আর মুখে হয়রানির ছাপ; নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। মেয়ের মুখে তার ক্ষোভের ছাপ। তার স্লিপে অতিরিক্ত তথ্যে মা-বাবার ঘরে লাল কালির চিহ্ন দেওয়া। অভিভাবকের নামের চিহ্নও নেই।
আমরা আরও ঘণ্টাখানেক ব্যয় করলাম পরিচালক আর প্রশাসনের কাছে আমাদের অভিযোগগুলো জানানোর জন্য। ডিজির কাছেও যেতাম। কিন্তু পরিচালকের পিএ বললেন, ডিজি সাহেব পরিচালকসহ বৈঠকে আছেন। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথে বিকেল সাড়ে চারটার পর আমরা বাড়ির পথ ধরলাম।
কিছুক্ষণ আগে ঘাটে ঘাটে দেনদরবারের সময় নানা কথা ও যুক্তি শুনেছি। আমার মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে শুনলাম, রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট নেয়, নারী পাচার হয় তাই নাকি আমাদেরও এই বিভ্রাটে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পড়তে হয়েছে। তা হলে বায়োমেট্রিক উপাত্ত সংগ্রহকারী কর্মকর্তারা প্রশ্ন করে এসব ধরার মতো বড় গোয়েন্দাগিরিতেও দক্ষ! এমনও শুনলাম, আমাদের দেশের মানুষ এসব বিষয়ে সচেতন নয়, কী আর করা যাবে!
তা হলে তো সমস্যা মিটেই গেল। আমরা এমনই থেকে যাই। নাগরিকদের গরু-ছাগলের পালের মতো সারা দিন অমানবিকভাবে ঘুরপাক খাওয়াই এবং নিজেদের কঠোর কর্তব্য অথবা অসংবেদনশীলতা নির্বিবাদে দেখাতে থাকি। আমাদের কাগজপত্রে সন্দেহ হলে কর্মকর্তারা সেগুলো যাচাই করতে অবশ্যই পারেন। কিন্তু নিছক কিছু একটা মনে হওয়ার বশে হেনস্তা করতে পারেন কি? আমার মেয়েকে কেন এর শিকার হতে হবে? মেয়েকে আমি শক্ত করে গড়ছি। সে বাইরে ভেঙে পড়েনি বা কেঁদে ফেলেনি। কিন্তু তার মনে আঘাত লেগেছে, সে বড় ক্ষুব্ধ হয়েছে।
ফেরার পথে ডেলিভারি স্লিপগুলো আবারও খুঁটিয়ে দেখলাম। আমাদের খাসা ছবি উঠেছে! আমার আধা পাকা উড়া ধুরা চুলে আর মুখে হয়রানির ছাপ; নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। মেয়ের মুখে তার ক্ষোভের ছাপ। তার স্লিপে অতিরিক্ত তথ্যে মা-বাবার ঘরে লাল কালির চিহ্ন দেওয়া। অভিভাবকের নামের চিহ্নও নেই।
যত দিন যাচ্ছে, নানা কাজে বুঝতে পারছি আমার মেয়েটিকে এমন আরও অনেক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। আপনারা দোয়া করবেন, সে যেন সব ক্ষুদ্রতার আঘাত গায়ে না মেখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
আশা করি, কোনো একদিন আমার এবং তার পুরোনো পাসপোর্ট দুটি নবায়ন হয়ে ই-রূপে আমাদের হাতে আসবে। আল্লাহ ভরসা।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা সাংবাদিক ও লেখক