নথি ব্যবস্থাপনা: খসড়া আইনে বেসরকারি আর্কাইভের অবস্থান
দেশের আর্কাইভ ও নথি ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত ভিত্তিদানের জন্য ৫–৬ বছর ধরে একটি আইন প্রণয়নের তৎপরতা চলছে। ইতিমধ্যে ৫–৬ বার খসড়া আইন প্রণীত হয়েছে। ২০১৫ সালের ৯ জুন এই আইন বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস (এনএবি) এবং নথি ব্যবস্থাপনা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে প্রথম আলোতে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে ২৫ জুলাই প্রথম আলোয় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি কেলভিন স্মিথ বাংলাদেশের নথি ব্যবস্থাপনার সার্বিক অবস্থা জরিপ করে প্রতিবেদনে খসড়া আইন সম্পর্কে বেশ কিছু সুপারিশ প্রদান করেন। জানা গেছে, বর্তমানে আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে আছে। আইনের সর্বশেষ খসড়াটি আগের খসড়াগুলোর চেয়ে অনেক উন্নত, তবে পূর্ণাঙ্গ নয়। এটিকে আরও উন্নত ও যুগোপযোগী করার সুযোগ আছে। এই ছোট লেখায় বিশদ আলোচনার সুযোগ নেই; শুধু বেসরকারি আর্কাইভ নিয়ে কিছু সুপারিশ রাখব।
সারা বিশ্বে জাতীয় আর্কাইভের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে গঠিত আর্কাইভও যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণে এ ধরনের আর্কাইভের অবদান সবচেয়ে বেশি। ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের চাহিদা ও উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে বেসরকারি আর্কাইভের জন্ম হয়। পরে তা বড় হতে থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়। এভাবে গড়ে ওঠা আর্কাইভের কারণে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সামাজিক ও স্থানীয় ইতিহাসের উপাদানগুলো সংরক্ষিত হয়।
ইউনেসকো এবং আর্কাইভস বিষয়ে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক ও কমনওয়েলথ সংস্থা (আইসিএ এবং এসিএআরএম) বেসরকারি আর্কাইভ বিষয়ে নির্দেশিকা, মতামত ও সুপারিশ প্রকাশ করে থাকে। ইউনেসকোর একটা মতামত এমন: বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তির মালিকানায়, দখলে অথবা অধিকারে থাকা নথিও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। তাই এগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির প্রয়োজন আছে। নজরদারি ফলপ্রসূ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এর অর্থ এই নয় যে এসব নথির আবেগীয় মূল্য বা বাজারমূল্য কমে গেছে, অথবা আইনানুগ মালিকের অধিকার রহিত হয়ে গেছে; বরং [আইন দ্বারা] বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় ক্ষেত্রে নথির উৎস [বেসরকারি আর্কাইভ] সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে সাধারণভাবে সম্প্রদায়ের সুবিধা এবং সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির উন্নতি সাধনের জন্য আইনানুগ মালিকদের নিয়মের আওতায় আনা।
বেসরকারি আর্কাইভ গড়ে উঠলে সরকারের ব্যয়ভার লাঘব পায়। এ কারণে বিভিন্ন দেশের সরকার বেসরকারি আর্কাইভ প্রতিষ্ঠায় উত্সাহ জোগায়। আমাদের দেশেও একাধিক বেসরকারি আর্কাইভ আছে, যা স্থানীয় বা সামাজিক পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট নথি সংরক্ষণ করছে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রাজশাহী হেরিটেজ আর্কাইভস ইত্যাদি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু বেসরকারি আর্কাইভ গড়ে উঠেছে; সেগুলোতে স্বল্প হলেও গুরুত্বপূর্ণ নথি বা স্মারকের সন্ধান পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সুপারিশের আলোকে লাটভিয়া, নেদারল্যান্ডস, ক্রোয়েশিয়া, ওমানসহ বেশ কয়েকটি দেশের আর্কাইভ–সংক্রান্ত আইনে বেসরকারি আর্কাইভের সংজ্ঞাসহ জাতীয় আর্কাইভ ও বেসরকারি আর্কাইভের পারস্পরিক সম্পর্ক, সহযোগিতা, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু ধারা-উপধারা যুক্ত আছে। এই ধারা-উপধারাসমূহের সারাংশ হচ্ছে:
১. জাতীয় আর্কাইভ বেসরকারি আর্কাইভসমূহ জরিপ করবে, সেখানে সংরক্ষিত নথির তালিকা প্রণয়ন করবে, নিয়মিতভাবে পরিদর্শন করবে, নথি সংরক্ষণে সাহায্য করবে, বেসরকারি আর্কাইভের জন্য নীতিমালা তৈরি করবে, আইনি সুরক্ষা দেবে, প্রয়োজনে অর্থ সাহায্য প্রদান করবে;
২. জাতীয় আর্কাইভ প্রয়োজন মনে করলে বেসরকারি নথিকে সরকারি নথির মর্যাদা দেবে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে ক্রয় বা দান হিসেবে গ্রহণ করে তা জাতীয় আর্কাইভে স্থানান্তর করবে। জরুরি মনে করলে বেসরকারি আর্কাইভে সংরক্ষিত সব নথি বা এর অংশবিশেষ জাতীয় আর্কাইভের জন্য কপি করবে।
৩. বেসরকারি আর্কাইভ জাতীয় আর্কাইভে নিবন্ধন করবে, বেসরকারি আর্কাইভের সংগ্রহ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দেবে, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হবে, গবেষকদের জন্য নথিপত্র উন্মুক্ত রাখবে।
বাংলাদেশের খসড়া আইনে বেসরকারি আর্কাইভ ও বেসরকারি নথির পৃথক সংজ্ঞা দেওয়া না হলেও এর বিভিন্ন ধারায় ‘ব্যক্তিগত অধিকারে থাকা’, ‘বেসরকারি বা ব্যক্তিগত দখলে থাকা’, ‘ব্যক্তি পর্যায়ের’, ‘কোনো ব্যক্তির নিকট বা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে’ ইত্যাদি ধরনের শব্দসমষ্টি দ্বারা বেসরকারি আর্কাইভ ও নথির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা যায় যে আইনে সরকারি বা জাতীয় আর্কাইভের বাইরে সব আর্কাইভকে বেসরকারি আর্কাইভ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি আর্কাইভ বিষয়ে খসড়া আইনের ধারা ১০ (১)তে উল্লেখ আছে, ‘সরকারি রেকর্ড কিংবা বেসরকারি বা ব্যক্তিগত দখলে থাকা আর্কাইভাল রেকর্ড রাখা হইয়াছে এইরূপ যে কোন স্থানে মহাপরিচালকের প্রবেশের অধিকার থাকিবে এবং উহার তালিকা তৈরি বা উহা হইতে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পরীক্ষা করার বা উহা জাতীয় আর্কাইভসে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্থানান্তরের জন্য আবশ্যকীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা রাখিবেন।’ ১৬(৩) ধারায় উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে ৩০ বছরের অধিক পুরোনো ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ নথি থাকলে তা জাতীয় আর্কাইভের মহাপরিচালককে অবহিত করতে হবে। প্রয়োজনে তিনি এসব নথি পরিদর্শন করবেন। নথির বয়স ৭৫ বছর হলে তিনি তা জাতীয় আর্কাইভে স্থানান্তরের আদেশ দিতে পারবেন।
এই দুই ধারার প্রয়োগ হলে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা আর্কাইভগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং এ ধরনের আর্কাইভ সৃষ্টি ও পরিচালনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনকি বেসরকারি পর্যায়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হতে পারে। কারণ, খসড়া আইনের ধারা ১৭ (১)-এ বর্ণিত আছে যে বেসরকারি সংগ্রহে থাকা নথির বয়স ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে মহাপরিচালকের অনুমোদনে রপ্তানি করা যাবে। অর্থাৎ নথির বয়স ৭৫ বছরের নিচে হলে রপ্তানির জন্য অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।
সুপারিশ করছি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি আর্কাইভ গঠন উৎসাহিত করা হোক এবং এনএবির নেতৃত্বে বেসরকারি আর্কাইভগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হোক। এ জন্য বেসরকারি আর্কাইভ বিষয়ে ইউনেসকো, আইসিএ, এসিএআরএমের সুপারিশ এবং বিভিন্ন দেশের আইনের ধারাগুলো আমলে নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় আর্কাইভ আইনে কিছু ধারা সংযুক্ত করা হোক।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক প্রথম আলোর গবেষক