২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

নতুন দিনের নতুন শিশুর হাতে ‘পুরোনো’ বই কেন

স্কুলের ছুটিতে টোকনের মামাবাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় তার মন খারাপ হয়ে যায়। মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা তাকে আম-আঁটির ভেপু, ক্ষীরের পুতুল, সাগরতলের জগৎ, আকাশের রহস্য ইত্যাদি বই পড়তে দেওয়ায় তার ছুটি চমৎকার কাটে এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘বই পড়ার আনন্দ’ নামের এই গল্পের কথা মনে পড়ল একজন শিক্ষকের মন্তব্যে। স্কুল বন্ধের সময় তাঁর কোচিংয়ে ছুটি থাকে। তিনি চান ছাত্রছাত্রীরা বই পড়ে, খেলে বা নিজেদের ভালো লাগে, তেমন কিছু করেই সময় কাটাক। কিন্তু মা-বাবা তাদের অবসর না দিয়ে সেই ছুটিতে অন্য কোচিংয়ে দিয়ে দেন।

পরীক্ষায় ভালো ফল করাকে সন্তানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করার যে প্রবণতা বাংলাদেশের অধিকাংশ মা-বাবা ও অভিভাবকদের মধ্যে দেখা যায়, তা উদ্বেগজনক। অনেকে স্মার্টফোনে শিশুকে ব্যস্ত রাখছেন। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিশুদের চোখের ক্ষতি হচ্ছে, কেউ কেউ সঠিকভাবে কথা বলতে শিখছে না। অনেক মা-বাবা ও অভিভাবক বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতন নন। বই পড়লে শিশুদের কল্পনাশক্তির বিকাশ হয়। যখন আমরা পর্দায় কিছু দেখি, তখন কল্পনার অবকাশ থাকে না। মানুষের সৃষ্টিশীলতার মূলে আছে কল্পনাশক্তি। বই পড়লে শিশুদের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা, মনোযোগ এবং যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ে। শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

বর্তমান সময়ে অনেক মা-বাবা ও অভিভাবক সন্তানদের পোশাক, খেলনা, বাইরে খাওয়া, বেড়ানো ইত্যাদিতে প্রচুর খরচ করলেও বই কিনতে চান না। বই কেনার জন্য পারিবারিক বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। অল্প বয়স থেকেই শিশুদের বই পড়ে শোনানো, তাদের বই কিনে দেওয়া এবং লাইব্রেরিতে, বইমেলায় এবং বইয়ের দোকানে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন উৎসব ও জন্মদিনে উপহার হিসেবে বই দিলে শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে। শিশুদের খেলাধুলা, ছবি আঁকা, সংগীতসহ নানা ধরনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা দরকার। পরিবারের বড়দের ল্যাপটপ–স্মার্টফোনে সময় কাটানো কমাতে হবে। মা-বাবা ও অভিভাবকদের বই পড়তে দেখলে শিশুরাও বই পড়বে।

এক শ বছরের বেশি আগে ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘আমি লাইব্রেরিকে স্কুল–কলেজের উপরে স্থান দিই এই কারণে যে এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়, প্রতি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।’ বই পড়ার অভ্যাস গঠনে বিদ্যালয় এবং এলাকাভিত্তিক পাঠাগারের ভূমিকা আছে। কানাডার এডমন্টনের পাবলিক লাইব্রেরিতে শিশুদের জন্য এক গল্পের আসরে গিয়েছিলাম। কানাডার মেটি গোষ্ঠীর গল্প ‘গিভিং ট্রি’ পড়ে শোনালেন একজন মেটি। গল্পপাঠ শেষে পুঁতি দিয়ে মেটি ফুল বানাতে শিখল শিশুরা। এডমন্টন পাবলিক লাইব্রেরিতে গল্প শোনানোর পাশাপাশি পাপেট শো, শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা ধরনের আয়োজন সারা বছর ধরেই চলে। পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন শহরে বইয়ের দোকানেও শিশুদের জন্য গল্পের আসর বসে। বাংলাদেশেও এ ধরনের আয়োজন সম্ভব।

বিভিন্ন বয়সের শিশুদের অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও পড়ার গতি আলাদা হয়। পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। এসব বিবেচনা করেই বই লিখতে হবে। এ ক্ষেত্রে লেখক, আঁকিয়ে, প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।

লন্ডনে বসবাসের সময় টটেনহ্যাম কোর্ট রোডের বিশাল বইয়ের দোকান ফয়েলসে প্রায়ই যেতাম। সব রকমের বইয়ের চমৎকার সংগ্রহ এর ছয়তলাজুড়ে। নিচতলায় বিভিন্ন বয়সী শিশুদের জন্য অনেক বই। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, প্রকৃতি, চিরায়ত সাহিত্য, রূপকথা, পুরাণসহ নানা ধরনের বই দেখে মুগ্ধ হতে হয়। জুডিথ কের রচিত ক্ল্যাসিক ‘দ্য টাইগার হু কেম টু টি’ থেকে শুরু করে ‘টিনটিন’ হয়ে ‘হ্যারি পটার’—সবই আছে। ধাঁধা, স্টিকার ইত্যাদির বইও রয়েছে প্রচুর। কিছু বই ছাপা হয়েছে তুলতুলে নরম কাপড়ের ওপর, যাতে কয়েক মাস বয়সী শিশুরাও বই ভালোবাসতে শেখে। কোনো বইয়ের সঙ্গে চরিত্রের আদলে খেলনা দেওয়া হয়েছে। বইয়ের কাহিনি, অলংকরণ এবং মুদ্রণ নিয়ে নানা ধরনের চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

ঢাকার কয়েকজন অভিভাবক জানালেন, তাঁদের সন্তানেরা ইংরেজি বই পড়লেও বাংলা বই পড়তে চায় না। বইয়ের বিষয় ও প্রকাশনার মান তাদের আকৃষ্ট করে না। বিভিন্ন বয়সের শিশুদের অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও পড়ার গতি আলাদা হয়। পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। এসব বিবেচনা করেই বই লিখতে হবে। এ ক্ষেত্রে লেখক, আঁকিয়ে, প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।

মনে পড়ছে অক্সফোর্ডের স্টোরি মিউজিয়ামের কথা, সেখানে গল্প নিয়ে এক মহাযজ্ঞ চলছে। পুরোনো গল্প নিজের মতো করে লেখা, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি শব্দ থেকে গল্প সৃষ্টি করা, গল্পের চরিত্রের মতো সাজা, ছবি আঁকাসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে শিশুরা অংশ নিতে পারে। স্থানীয় অনেক বিদ্যালয়ে এই মিউজিয়ামের কার্যক্রম আছে। রয়েছে ছিমছাম স্টোরি ক্যাফেতে শিশুদের জন্য নিয়মিত গল্প বলার আসর। এ ছাড়া গল্পের চরিত্র নিয়ে বিশেষ আয়োজন করা হয়। এমন কিছু উদ্যোগ আসন্ন অমর একুশে বইমেলায় নেওয়া যায়। স্টলসজ্জা শিশুদের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। শিশুরা যাতে নিরাপদে, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং আনন্দের সঙ্গে মেলায় সময় কাটাতে পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে শিশুদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বইমেলা শিশুবান্ধব হবে, সেই প্রত্যাশা করি।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী