আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা ‘আইসিটি’ মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার পরিচালনা করছেন, গত ২৫ মার্চ সেটির পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাই এ নিয়ে নির্মোহ মূল্যায়ন ও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দরকার। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদ ওরফে ‘বাচ্চু’ রাজাকারকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ওটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম রায় এবং ওই রায়ে মুক্তিযোদ্ধা, নাগরিক সমাজসহ সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেন। ওই একই ট্রাইব্যুনাল পরের মাসে, অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। রায়ের পর কাদের মোল্লা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের মানুষ। অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ব্যাপারে গরিষ্ঠসংখ্যক জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন রয়েছে।
গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবুল কালাম আযাদকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড, অথচ ওই একই অপরাধে (সুনিশ্চিতভাবে তাঁর চেয়েও ভয়াবহ অপরাধে) আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৬ দিনের ব্যবধানে প্রদান করা হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড! এ জাজমেন্টের ‘জুরিসপ্রুডেনশিয়াল’ (বা আইনবিজ্ঞান ও আইনের নীতিমালাসংক্রান্ত) আলোচনা ও বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ হলেও রায়ের অংশটি ছিল দুর্বল ও অসংগতিপূর্ণ। বিশেষ করে আলুদীতে ৩০০ ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও কেন কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হলো, সে বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল কোনো যুক্তি (ও ব্যাখ্যা) প্রদান করেননি। ফলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আপিলের শুনানির পর ট্রাইব্যুনালের রায় পরিবর্তন করে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আদালতের রায় কার্যকর করা হয় এবং এটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কোনো রায়ের প্রথম বাস্তবায়ন।
পাঁচ বছর ধরে চলা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২ এ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ১৪ জনকে। (তাঁদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান ও সাবেক নেতা ১০ জন, বিএনপির নেতা দুজন, আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা একজন ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী একজন।) বয়সের কথা বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড এবং বিএনপির নেতা আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন।
গোলাম আযমের মামলার একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ অথবা জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের দায়িত্ব নীতিমালা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গোলাম আযমের শাস্তি নিশ্চিত করা। ১৯৪৬ সালে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করে রিবেনট্রপ, ফ্রাঙ্ক, রোসেনবার্গ ও জুলিয়াস স্ট্রেইচারসহ নাজি যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য দণ্ডে দণ্ডিত করেন। টোকিও ট্রায়ালেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে গোলাম আযমের মামলায় প্রসিকিউশন এ নীতিমালাটিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন এবং ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। কেননা, গোলাম আযম কোনো কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেননি, কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানেরা বাঙালি নিধন, মুক্তিযোদ্ধা নির্মূল, নারী নির্যাতন ও লুটতরাজের যে ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন করেছিলেন, তার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে তৎপর ছিলেন তিনি। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী তাঁর (এবং তাঁদের) নির্দেশেই গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ সারা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে। ফলে জ্যেষ্ঠ ও নির্দেশ প্রদানকারী নেতা হিসেবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় গোলাম আযম এড়াতে পারেন না। এ জন্য ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু এ রায়ের ব্যাপারেও অনেকেই ÿক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কেননা, তাঁদের মতে, অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে অপরাধের নৃশংসতা ও ভয়াবহতা, বয়স নয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনকে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা। কিন্তু এ রায়ের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। কেননা, লন্ডনে অবস্থানরত মাঈনুদ্দিন ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আশরাফুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়েই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমা কিছু দেশ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। আর সেটি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে কোনো কোনো গোষ্ঠী। প্রাসঙ্গিকভাবেই কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে আইসিটিওয়াই বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফরমার যুগোস্লাভিয়া ও আইসিটিআর বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রোয়ান্ডার তো মৃত্যুদণ্ড প্রদানের এখতিয়ার ছিল না। চরম এ দণ্ডটি নেই আইসিসি বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের সংবিধিতেও। তাহলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কেন তা দিচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীর কোনো যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে তার ‘কনটেক্সট’, বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশা ও সংশ্লিষ্ট দেশের বিচারিক ব্যবস্থা থেকে আলাদা করে দেখা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অনুকূল নয়।
ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও শাস্তির বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন, টোকিও ট্রায়ালেও সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের দণ্ড আইন ও বিচারিক ব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড এখনো প্রচলিত। প্রচলিত বিচারিক ব্যবস্থায় যেখানে একটি হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড, সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গণহত্যার জন্য যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়, তাহলে তার চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে? আর কী করেই বা তা মেটাতে পারে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচারের দাবি?
স্কাইপ কথোপকথন হ্যাকিং, ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে রায় চুরির মতো ঘটনা সত্ত্বেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার হচ্ছে, তা স্বচ্ছ এবং খোলা। আইনের ‘যথাযথ প্রক্রিয়া’ (ডিউ প্রসেস) বলতে যা বোঝায়, সেটাকে মেনেই এটা হচ্ছে। কেননা, এ বিচারে কোনো লুকোছাপা নেই, প্রতিটি বিষয় জনগণের কাছে প্রকাশ্য, বিচারের খুঁটিনাটি প্রতিদিন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ‘রিপোর্টেড’ হচ্ছে। এ বিচারে দোষী ব্যক্তিরা শুধু আপিল নয়, সর্বোচ্চ আদালতের রিভিউয়ের সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছেন।
দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারটি ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। কেননা, আন্তর্জাতিক কোনো সাহায্য ছাড়াই, ভিনদেশি আইনজীবী ও বিচারক বাদেই, দেশীয় তদন্তকারী, আইনজীবী ও বিচারকদের দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এত অল্প সময়ে এবং কম খরচে, অথচ আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) ঠিক রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হচ্ছে বাংলাদেশে।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে ১৯৯৩-৯৪ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়া ও রোয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার শুরু হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি সমাপ্ত হয়নি। কম্বোডিয়ার গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য কম্বোডিয়ার বিদ্যমান বিচারিক কাঠামোর মধ্যে ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি চেম্বারস ইন দ্য কোর্টস অব কম্বোডিয়া’ বা (ইসিসিসি) গঠনের জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে দেনদরবারেই চলে যায় চার বছর। তারপর ইসিসিসি গঠন করে বিচার শুরুর আগেই গণহত্যার জন্য দায়ী খেমাররুজদের শীর্ষ নেতা পল পট, সন সেন, ইয়ান ইয়াতসহ অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারের প্রক্রিয়াও জটিল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এসব কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অনন্য।
শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক, মানবাধিকার ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক।