২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দারিদ্র্য ও কোটিপতি দুটিই বাড়ছে, করণীয় কী

অর্থনীতি বিষয়ের সুপরিচিত গবেষণা সংস্থা সানেম বলছে, দেশে দারিদ্র্যের সার্বিক হার বেড়েছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপ থেকে পাওয়া তাদের হিসাবে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগের চেয়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি প্রায় দ্বিগুণ দেখা যাচ্ছে জরিপে। নিঃসন্দেহে মহামারির আঘাত এটা।

কিন্তু মহামারি সবাইকে পরাভূত করতে পারেনি। চায়ওনি হয়তো। মারির মধ্যেই দেশে ছয় মাসে কোটিপতি ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩টি। ২০২০-এর মার্চে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। সেপ্টেম্বরে তুমুল করোনার মধ্যে সেটা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া ছয় মাসের এসব তথ্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।

সানেমের জরিপ সারা দেশে হয়নি। তাদের নমুনা সংখ্যা ৫ হাজার ৫৭৭। এ রকম জরিপ দেশজুড়ে আরও ব্যাপক আকারে হলে আরও নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে। তবে সীমিত এই জরিপও মাঠের পরিস্থিতির কিছু ইঙ্গিত নিশ্চয়ই দেয়।

নতুন করে দারিদ্র্যের দীর্ঘমেয়াদি চক্রে মানুষ
সানেমের খানা জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে উপায়হীন বিপুল মানুষ খাবারের বাইরে অন্য অনেক খরচ বাদ দিচ্ছে। খাবারের তালিকাও কাটছাঁট করেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙেছে এবং ভাঙছে। এসবের সঙ্গে দারিদ্র্য বাড়া–কমার সম্পর্ক সবার জানা। সানেম বাড়তি যেটা বলছে, নতুন পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষ শিক্ষা ব্যয়ও কমাতে বাধ্য হচ্ছে। চিকিৎসা খরচ সামলাতে পারছে না।

২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে অতিদরিদ্র পরিবারগুলো আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ ভাগের বেশি শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে ফেলার তথ্য দিয়েছে। এর মানে দাঁড়ায়, দীর্ঘমেয়াদি এক দারিদ্র্যের চক্রে ঢুকছে এই মানুষেরা। কম শিক্ষা মানেই কম মজুরি, আর কম আয়ের এক দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়া। এভাবে বিপুল জনগোষ্ঠী যখন শিক্ষা ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়, তখন সমাজে অসমতা কাঠামোগত রূপ পেতে থাকে। এই অর্থে বাংলাদেশের আজকের নতুন পরিস্থিতি একধরনের নীরব কাঠামোগত সহিংসতার মতো; দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা যার শিকার।

৬-৭ কোটি মানুষ যদি দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকে এবং মাত্র ১-২ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্রমে সম্পদের বড় অংশ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, তাহলে সেটা কেবল অর্থনীতির বিষয় থাকে না, সামাজিক বিপদের পাটাতন তৈরি করে।

এই জরিপের আরেকটি মনোযোগ পাওয়ার মতো দিক হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা বেড়ে যাওয়া। দেখা যাচ্ছে, রাজশাহী ও রংপুরে দারিদ্র্যের হার ৫০ ভাগের অনেক ওপরে উঠে গেছে। বরিশাল, ঢাকা, সিলেটে যা ৪০ শতাংশের কম। সামগ্রিকভাবে গড়ে অতিদরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে।
এসব তথ্য অন্য সংস্থার জরিপে হয়তো কমবেশি হবে কিছুটা। তবে, গত বছরের মাঝামাঝি এ রকম যেসব জরিপ হয়েছে, তাতেও দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতির স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। এসব জরিপে সাধারণ যে বার্তাটি মিলছে, দারিদ্র্য মোকাবিলায় পুরোনো অর্জনগুলো মহামারি ওলট–পালট করে দিয়েছে।

দারিদ্র্যের পাশাপাশি সম্পদের পুঞ্জীভবন
সানেমের জরিপকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে মনে হয় দেশে দারিদ্র্য বাড়ার পাশাপাশি সম্পদও ব্যাপক হারে বাড়ছে। তবে গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে সেসব।

অর্থাৎ দেশের সামনে সমস্যা কেবল একটা নয়, একাধিক। ব্যাংকে টাকা বেড়ে যাওয়ার হয়তো বহু কারণ আছে। কিন্তু ৬-৭ কোটি মানুষ যদি দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকে এবং মাত্র ১-২ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্রমে সম্পদের বড় অংশ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, তাহলে সেটা কেবল অর্থনীতির বিষয় থাকে না, সামাজিক বিপদের পাটাতন তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিকালে এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য অতি বাজে খবর। মুষ্টিমেয় মানুষ উল্কার বেগে ধনী হতে থাকবে আর দারিদ্র্যের হার ক্রমে স্ফীত হতে থাকবে—এই দৃশ্য উদ্‌যাপনের জন্য গরিব শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা নিশ্চয়ই একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেনি। অথচ সেটাই ঘটছে।

কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ ট্যাক্সের প্রতিবেদনেও একই রকম ইঙ্গিত মিলেছিল। তারা এ বিষয়ে পরপর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৮ ও ২০১৯-এ। আর্থিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা বলেছিল, অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ অতি এগিয়ে।

সমাজের নিচুতলার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে নতুন করে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার এখনই। দেশজুড়ে খাদ্যসহায়তাও জরুরি। এটা করতে অতি ধনী ও ধনীদের থেকে কর আকারে বাড়তি সম্পদ নিতে হবে রাষ্ট্রকে।

২০১৮ সালের পরের তথ্য ২০২৩ পর্যন্ত প্রক্ষেপণ শেষে তারা বলেছিল, আড়াই শ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। হারটা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, আর্থিক খাতে মোট আমানতের ৪২ ভাগই কোটিপতিদের আমানত। অর্থাৎ এমন একটি সমীকরণে পড়েছে বাংলাদেশ, যেখানে পুরো দেশ বনাম এক লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
করোনা বাংলাদেশকে ১৫ বছর আগে নিয়ে গেল।

ধনীর সংখ্যা বাড়া সাধারণভাবে কোনো দেশের জন্য খারাপ খবর নয়। বরং প্রত্যেক মানুষকে ধনী করে তোলাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত যেকোনো দেশের নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু এ রকম লক্ষ্য বাস্তবায়নের মধ্যে যদি দ্রুত হারে কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র হতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে লক্ষ্য ও বাস্তবতার মধ্যে কোথাও সমস্যা বেধেছে। এই সমস্যাটি কেবল অর্থনীতির ব্যবস্থাগত বিষয় নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যদি কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্থ পুঞ্জীভূত হতো, তাহলেও দেশে দারিদ্র্য এত তীব্র হয়ে উঠত না। চুইয়ে পড়ে হলেও কিছু সম্পদ সমাজের নিচুতলায় আসত।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সম্পদের পুঞ্জীভবন অনিয়ম ও অনৈতিক উপায়ে ধনী হওয়ার ধারণা সামনে নিয়ে আসে। চলতি স্বাস্থ্য-দুর্যোগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের পেশাগত জীবনে যেভাবে আঘাত হেনেছে, ধনীদের সম্পদ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় তেমন আঘাত হেনেছে বলে ব্যাংকিং সাক্ষ্য মিলছে না। অর্থনীতির স্বীকৃত ও প্রকাশ্য প্রক্রিয়ায় যদি এসব সম্পদ সংগ্রহ হয়ে থাকে, তাহলে করোনাকালে তার এ রকম অক্ষত থাকা ধাঁধা বৈকি। যদিও এই ধাঁধার উত্তর অনুমান করা কঠিন নয়।

তবে যে কারণেই সম্পদের পুঞ্জীভবন ও দারিদ্র্য বাড়ুক, সেটা বাংলাদেশকে আবার প্রায় ১৫ বছর আগে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, ২০০৫ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ মতো ছিল। এখন আবার একই চিত্রে প্রবেশের মানে জাতীয় জীবন থেকে দারিদ্র্যবিরোধী লড়াইয়ের ১৫টি বছর হারিয়ে যাওয়া।

কোভিড মহামারির অভিঘাতে দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে
ছবি প্রথম আলো

এই ‘১৫ ’কে যদি আমরা ‘২০’-এ পরিণত করতে না চাই, তাহলে অবিলম্বে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ জরুরি। এ রকম হস্তক্ষেপে সাধারণভাবে দুটি দিক থাকে। অতি ধনীদের থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে পুরোনো ও নতুন দরিদ্রদের মধ্যে সেটা বণ্টন ও পুনর্বণ্টন। রাষ্ট্র বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ রকম পুনর্বণ্টন করছেও। কিন্তু সেসব কর্মসূচির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া-সুফল বাস্তব বিপদ কতটা রুখতে পারছে, তা নিয়ে পুনর্ভাবনা দরকার। সানেমের জরিপ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপাত্ত সে বার্তাই দিচ্ছে।

বাংলাদেশ এখন কী করবে?
‘সিআরআই’ নামে পরিচিত বৈষম্য কমানোর বৈশ্বিক সূচকে গত বছর বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৫৮ দেশের মধ্যে ১১৩। নতুন পরিস্থিতিতে অবস্থান কী দাঁড়াবে আমরা জানি না। জনজীবনে আর্থিক অসমতার মাত্রা যে পর্যায়ে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলছে, তা উদীয়মান এক মহা বিপৎসংকেত বৈকি। নতুন করে নিবিড়ভাবে অর্থনীতির এই বিপদ মোকাবিলা প্রয়োজন।

সমাজের নিচুতলার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে নতুন করে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার এখনই। দেশজুড়ে খাদ্যসহায়তাও জরুরি। এটা করতে অতি ধনী ও ধনীদের থেকে কর আকারে বাড়তি সম্পদ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। এর বিকল্পও আছে। তা হলো ধনীদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্নে চলতে দেওয়া আর দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের স্থায়ীভাবে চুপচাপ রাখতে রাষ্ট্রকে আরও কঠোর ও নির্মম করে তোলা। কোন বিকল্প বেছে নিলে কী হয়, তার অসংখ্য নজির আছে ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। বাংলাদেশ ‘রাষ্ট্র’ কোন দিকে যাবে এবং যাচ্ছে?

আলতাফ পারভেজ গবেষক