তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরানকে এক করছে চীন?

২৭ মার্চ ইরান ও চীনের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে
-

ক্ষমতা কখনো ঘুমায় না। ক্ষমতাযন্ত্রকে সারাক্ষণ নজর খোলা রেখে হুমকি খুঁজতে হয়, পাহারা দিতে হয় নিজের স্বার্থকে। করোনা মহামারিতেও থেমে নেই ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। বরং তা আরও বেড়েছে।

গত ২৭ মার্চ ইরান ও চীনের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় রয়েছে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। এই চুক্তি ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের চেষ্টার ওপর প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে ইরান ও তুরস্ককে জড়িত করায় বড় ভূমিকা ফেলবে এই চুক্তি।

অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিকে এখন আর আলাদা করা হয় না। আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা ইরান, রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান সবারই দরকার। পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী হোসেইনি সম্প্রতি বলেছেন, ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া ও চীনের নতুন এক জোট গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এর উদ্দেশ্য হবে ওই অঞ্চলের আরও উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা বলে তিনি অভিমত দেন।

ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক বিভিন্ন সময়েই জোট তৈরি করেছিল। ১৯৫৫ সালের বাগদাদ প্যাক্ট থেকে জন্ম নিয়েছিল সেন্টো জোট। এতে ছিল পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও ব্রিটেন। তখন মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্কের এই জোটে তখনকার পরাশক্তি ব্রিটেনের জায়গা নিয়েছে এখনকার উঠতি বিশ্বনেতা চীন।

মূলত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব কমানোই চীনের ইরান ও তুরস্ককে কাছে টানার উদ্দেশ্য। তুরস্ক ও ইরান যে সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের যুদ্ধে জড়িয়েছে, তার কারণও যার যার পক্ষে প্রভাববলয় বাড়ানো। তেলকুবের আরব রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত সৌদি জোটকে এক পাশে সরতে বাধ্য না করে সেটা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার স্বার্থ মিলে যাওয়ার কারণেই এ ধরনের বৃহৎ জোট এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরানোর ঘোষণা দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান চাইবে আবারও আফগানিস্তানের ওপর প্রভাব বাড়াতে। এই কাজে চীন-পাকিস্তান এক কাতারেই থাকবে। সুতরাং পাকিস্তান থেকে ইরান পর্যন্ত যদি জোট গড়ে ওঠে, তা চীনের রক্ষাবলয় হিসেবে কাজ করবে।

যদিও ইরান ও তুরস্ক উভয়ই চাইবে মুসলিম দুনিয়ার নেতা হতে। তাহলেও তুরস্কই এগিয়ে থাকবে। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও দক্ষিণ ককেশাস এলাকা আর গ্রিসের সাগরেও তুরস্ক উপস্থিতি বজায় রাখছে। নিজেদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতাই থাকুক, বৈরী আরব রাষ্ট্রগুলোর কারণে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে দেশ দুটির সম্পর্ক জোরদার হওয়া অঙ্কের হিসাবের মতোই স্পষ্ট।

অন্যদিকে তুর্কি-পাকিস্তান সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এরদোয়ান সম্প্রতি বলেছেন, ‘তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক কোনো ঐচ্ছিক ব্যাপার নয়, এটা হলো বাধ্যবাধকতা। উভয় দেশ দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল ও যুদ্ধবিমান তৈরিতে একসঙ্গে কাজ করছে।

সম্প্রতি দুই দেশ আতাতুর্ক ১১-২০২১ নামে যৌথ সামরিক মহড়াও দিয়েছে। তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতার কথাও বলা হচ্ছে। ইরান ও তুরস্কের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকা মানে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার হিসাব সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া।

ঐতিহাসিকভাবে ইরান পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ করেছে। চীন ও ইরান চুক্তি নতুন সেই যোগাযোগেরই সোপান। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) যে পথ পেতেছে, সেই পথে আর কোন কোন দেশ এভাবে জড়ায়, তা এখনো দেখার অপেক্ষা।

তবে মনে হচ্ছে, মহামারি মানবতার জন্য মারাত্মক হয়ে উঠলেও চীন ও তার মিত্রদের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে।

(তথ্যসূত্র: এশিয়া টাইমস)
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]