যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের প্রতিনিধিরা কাতারের রাজধানী দোহায় টানা ১৬ দিনের বৈঠক শেষ করলেন। ১২ মার্চ এ ম্যারাথন বৈঠক শেষে কোনো চুক্তি হয়নি বটে, তবে এ আলোচনা থেকে ১৭ বছর ধরে চলা আফগান যুদ্ধ অবসানে ভূমিকা রাখতে সক্ষম একটি শান্তিচুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে। বৈঠক শেষে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই একটি ‘খসড়া’ দাঁড় করিয়েছেন। এ খসড়ায় দুটি ইস্যু সামনে আনা হয়েছে। একটি হলো আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী পুরোপুরি সরিয়ে আনা। অন্যটি হলো তালেবান আল-কায়েদাসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে—এ মর্মে প্রতিশ্রুতি দেওয়া। একই সঙ্গে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে, আফগানিস্তানে রক্তপাত বন্ধে অন্যান্য বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা দরকার হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আলোচকদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জালমে খলিলজাদ। ওয়াশিংটনের উদ্দেশে দোহা ছাড়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের বলে গেছেন, শান্তির জন্য চারটি বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। সেগুলো হলো সন্ত্রাসবাদবিরোধিতা নিশ্চিত করা, সেনা প্রত্যাহার, আন্তআফগান সংলাপ ও একটি সমন্বিত অস্ত্রবিরতি। তিনি বলেছেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ ও কার্যকর সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রক্রিয়ার বিষয় চূড়ান্ত হয়ে গেলেই তালেবান এবং আফগান সরকারসহ অন্যান্য পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমন্বিত অস্ত্রবিরতি নিয়ে আন্তসংলাপ শুরু হবে।
এখন এটি পরিষ্কার যে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা কিংবা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অস্ত্রবিরতির বিষয়ে একমত হওয়া—এর কোনোটিই খুব সহজ হবে না। আফগানিস্তানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বের করতে আরও বহু শক্ত ধাপ পার হতে হবে। তারপরও দোহা আলোচনায় যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা নানা কারণেই যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করছে। এ বৈঠক থেকে খসড়ার কথা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো চুক্তিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত তালেবান ও মার্কিন কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবেন।
গোড়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তালেবানের কট্টর অংশ দাবি করে আসছে যে তারা আফগান যুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। তারা এ শান্তি আলোচনায় বাগড়া দিয়ে আলোচনা ভন্ডুল করে দিতে পারে। আরও ভয় ছিল, আলোচনার ধীরগতি দেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প অধৈর্য হয়ে কোনো রকম শান্তিচুক্তি ছাড়াই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। তবে আশার কথা হলো এখন পর্যন্ত সে রকম কিছুই হয়নি। জালমে খলিলজাদ টুইটারে বলেছেন, শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। সব পক্ষই যুদ্ধ অবসানে আগ্রহ দেখিয়েছে।
বোঝা যাচ্ছে, উভয় পক্ষ এখন সেনা প্রত্যাহারের দিনক্ষণ ঠিক করা এবং সন্ত্রাসী হামলা রোধ করার বিষয় সামনে রেখে আলোচনা করবে। বিষয়টি ঠিক হলেই আফগানিস্তানের সব পক্ষ শান্তি প্রতিষ্ঠার দিক নিয়ে আলোচনায় বসবে। সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দেনদরবার করবে। অস্ত্রবিরতির ক্ষেত্রে এটিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে মনে করা যেতে পারে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো দোহা বৈঠক যেদিন শেষ হয়, সেদিনই আফগানিস্তানের বাদঘিস প্রদেশে তালেবানের হামলায় ২০ জন আফগান সেনা নিহত হয়, ১০ জন আহত হয় এবং ২০ জন সেনাকে তালেবান ধরে নিয়ে যায়। এ ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে তালেবান আফগান সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখতে চায়। একই সঙ্গে লড়াইরত সব পক্ষের কাছে তারা অস্ত্রবিরতি কতখানি জরুরি, সেই বার্তা পৌঁছে দিতে চায়। আমেরিকার সঙ্গে তালেবানের ঐকমত্যে পৌঁছানো যত কঠিন ও জরুরি, ঠিক ততখানি জরুরি ও কঠিন বিষয় হলো আফগানিস্তানে লড়াইরত সব পক্ষের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো। আফগান সরকারের সঙ্গে বৈঠক করার বিষয়ে তালেবানের অস্বীকৃতি সরকারের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রভাবশালী বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই দেশের মধ্যে ও বিদেশে এই বার্তা দিতে চাচ্ছেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে আশরাফ ঘানি ক্ষমতায় আছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তালেবানের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হওয়া সম্ভব হবে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে মস্কোয় বিরোধী দলের সঙ্গে তালেবানের বৈঠক হয়েছে এবং আগামী এপ্রিলেই দোহায় কারজাই অনুসারীদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। তার মানে তালেবান আশরাফ ঘানিকে বাদ দিয়েই আলোচনা এগিয়ে নিতে চাচ্ছে। এতে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি থেকেই যাচ্ছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে আফগানিস্তানে রক্তপাত বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার পথে থেকেই যা করার করতে হবে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
আহমেদ রশিদ আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক গবেষক ও লেখক