তালেবান কি ক্ষমা চেয়ে তার দেশ শাসন শুরু করবে? এবার ক্ষমতা দখল করে তারা অন্তত এখন পর্যন্ত বলছে, নারীদের হিজাব পরলেই চলবে, নেকাবসহ বোরকা পরা লাগবে না। আরও বলছে, নারীদের তারা শিক্ষা এবং কাজ করার সুযোগ দেবে। এমনকি কয়েক দিন আগেই আফগান টিভি চ্যানেলে তালেবান নেতা নারী সংবাদ উপস্থাপকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। এটা যদি তাদের দৃষ্টিতে সহিহ ইসলামি বিধান হয়ে থাকে, তাহলে তারা ২৫ বছর আগে প্রথমবার নারীদের ওপরে যা করেছিল, সেটার জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর আগেরটাই যদি তাদের দৃষ্টিতে সহিহ ইসলামি বিধান হয়ে থাকে, তাহলে এখন তাদের এই পদস্খলনের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত, কারণ এখনো তারা বলছে তারা পূর্ণাঙ্গ শরিয়া আইনে দেশ শাসন করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবান কেন নিজেদের এভাবে পরিবর্তন করছে, কিংবা অন্তত করার কথা বলছে?
তালেবানও জবরদখলকারী
এই দেশের বহু মানুষ মোটাদাগে আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয় উদ্যাপন করছেন। কারও কাছে এটা ইসলামের বিজয়, কারও কাছে এটা আফগান জনতার পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা, আবার কারও কাছে এটা আফগানিস্তানে জবরদখলকারী শক্তিগুলোর বড় পরাজয়। যদিও উল্লাসকারীদের অনেকেই এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন—ইসলামি শরিয়া কায়েম করতে চাওয়া একটা গোষ্ঠী কীভাবে তাদের জিহাদ পরিচালনা করে ইসলামের দৃষ্টিতে আফিমের মতো হারাম একটি পণ্যের ব্যবসার আয় থেকে?
অনেকেই এই প্রশ্নও তুলছে না যে বিদেশি জবরদখলকারীদের তাড়ানো তালেবান নিজেরাও কি জবরদখলকারী নয়? একটা মিলিশিয়া গোষ্ঠী ২০ বছর অত্যন্ত শক্তিশালী কিছু দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছে—এতে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেই দেশের সমাজের একটা অংশ এদের সমর্থন করেছে। কিন্তু সেটা কত শতাংশ? এর মধ্যেই যেহেতু তালেবান ঘোষণা করেছে তারা গণতন্ত্র দেবে না, তার মানে নির্বাচনও হবে না। অর্থাৎ আমরা কখনো জানতে পারব না, ঠিক কত শতাংশ মানুষ এই গোষ্ঠীর সমর্থনে আছে। আমরা যারা অন্তত গণতন্ত্রের কথা বলি, তাদের তো উচিত ক্ষমতায় থাকার জন্য স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।
স্বদেশি জবরদখলকারীও জনগণের জন্য একই রকম অভিশাপ
জবরদখলকারী বাইরের হলেই একটা দেশের নাগরিকদের অকল্যাণ হয় আর সেটা যদি দেশের ভেতরের কেউ হয়, তাহলে নাগরিকেরা অনেক ভালো থাকবে—পৃথিবীর অনেক উদাহরণ এর বিরুদ্ধে যায়। নিজ দেশের, নিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষও হতে পারে জবরদখলকারী, ভয়ংকর নিপীড়ক।
বর্তমানে পৃথিবীতে দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় টিকে থাকা প্রধানমন্ত্রী কম্বোডিয়ার হুন সেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে জবরদখল করে কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় টিকে আছেন তিনি। অবশ্য হুন সেনকে যখন জবরদখলকারী বলছি, তখন তিনি প্রতিবাদ করবেন। তিনি বলেন, কম্বোডিয়ায় নিয়মিত নির্বাচন হয়, যেমন হয়েছে ২০১৮ সালেও। তাঁর অসাধারণ দেশ চালানোর স্বীকৃতিস্বরূপ সেই নির্বাচনে জনগণ ১২৫ আসনের সংসদের প্রতিটিতে তাঁর দলকে জিতিয়েছে। বিরোধী দলকে জনগণ একটি আসনেও নির্বাচিত করেনি। জানি, এই দেশের মানুষের কানে এই ধরনের কথা খুব অপরিচিত লাগবে না। আবার এই দেশের মানুষও এখন জানে এসব নির্বাচন কীভাবে হয়।
জবরদখলকারী বাইরের হলেই একটা দেশের নাগরিকদের অকল্যাণ হয় আর সেটা যদি দেশের ভেতরের কেউ হয়, তাহলে নাগরিকেরা অনেক ভালো থাকবে—পৃথিবীর অনেক উদাহরণ এর বিরুদ্ধে যায়। নিজ দেশের, নিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষও হতে পারে জবরদখলকারী, ভয়ংকর নিপীড়ক।
বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ ঘোষণা করা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচকে কম্বোডিয়াকে অথরিটারিয়ান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। স্কোরের দিক থেকে যার বৈশ্বিক অবস্থান ১৩০। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২১ পয়েন্ট নিয়ে ১৮০ দেশের মধ্যে কম্বোডিয়ার অবস্থান ১৬০। বিশ্বের দেশগুলোর বিচারব্যবস্থার মান পর্যালোচনা করে একটি সূচকের মাধ্যমে দেশগুলোর তুলনামূলক অবস্থান বোঝানো ওয়ার্ল্ড জাস্টিস রিপোর্টে ১২৮টি দেশের মধ্যে কম্বোডিয়ার অবস্থান ১২৭। একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সূচক যেমন মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, শিশুদের পড়াশোনা করার প্রত্যাশিত ব্যাপ্তিকাল, প্রাপ্তবয়স্কদের পড়াশোনা করার গড় ব্যাপ্তিকাল নিয়ে ইউনেসকোর তৈরি মানব উন্নয়ন সূচকে কম্বোডিয়ার অবস্থান অতি নিচুতে, ১৪৪তম। এমন আরও অনেক সূচক আছে, যেগুলো দিয়ে প্রমাণ করা যায় এই দেশের জনগণ কতটা খারাপ আছে।
জবরদখলকারী, নিপীড়ক শাসক, হোক বিদেশি কিংবা দেশি তাতে সাধারণ মানুষের কী আসে যায়? বরং নিজের লোকের হাতে নিপীড়ন আমাদের অহংবোধে হয়তো আঘাত করে আরেকটু বেশি। এ কারণেই বোধ করি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের ক্ষোভ-ক্রোধ-ঘৃণা পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি যতটা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল এই মাটির সন্তান রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে।
নিশ্চয়ই আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি না, তালেবান হুন সেন সরকারে পরিণত হবে। সময় বলবে তালেবান কেমন দেশ চালাতে যাচ্ছে, কিন্তু এর আগপর্যন্ত আমাদের ইতিহাসবোধ এবং ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমাদের ধারণা দিতে পারে আফগানিস্তান কেমন হতে যাচ্ছে।
তালেবান স্পষ্টতই পরাশক্তির ‘ভূরাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি’
শুরুতেই প্রশ্ন করেছিলাম নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে আফগানিস্তান কেন তার অবস্থান আগেরবারের ক্ষমতায় থাকার সময়ের চাইতে পাল্টেছে? মিডিয়ার সংবাদে আমরা জানতে পারছি, এবার ক্ষমতা দখল করায় তালেবানকে প্রধান সাহায্যকারী প্রধান তিন দেশ চীন, পাকিস্তান, রাশিয়ার প্রবল চাপের মুখে তালেবানকে নারীবিষয়ক অবস্থান পাল্টানোর ঘোষণা দিতে হয়েছে। শুধু সেটাই নয়, এই দেশগুলো তালেবানকে এই চাপ দিচ্ছে—তাদের স্বীকৃতি পেতে হলে এককভাবে ক্ষমতায় না থেকে নানা দল-মতের গোষ্ঠীগুলোকে সঙ্গে রাখতে হবে, যাতে আফগানিস্তানে একটা স্থিতিশীল সরকার তৈরি হয়। এই কারণেই তালেবানকে তাদের একসময়কার চরম শত্রু হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গেও বসতে হয়েছে। যখন এই লেখাটা লিখছি তখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে কোনো সরকার গঠিত হতে পারেনি, শুধু সরকারের ধরন এবং কারা কারা সরকারে থাকবে, সেই আলোচনায় সিদ্ধান্ত আসেনি বলে।
দীর্ঘকাল থেকে, বিশেষ করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের পর থেকেই দেশটি পরাশক্তিগুলোর একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’-এর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে যেসব গোষ্ঠী, দল, উপদল পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত হয়েছে, সেগুলো আসলে পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক দাবা খেলার ঘুঁটির চাইতে বেশি কিছু না। তালেবানও এর চাইতে মোটেও আলাদা নয়। অন্য ঘুঁটির চাইতে তালেবান অন্য একদিক থেকে আলাদা, কারণ ঘুঁটি হিসেবে তালেবান অন্য ঘুঁটিগুলোর চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। বলা বাহুল্য, বিশ্ব ইতিহাসের আর সব যুদ্ধের মতোই এসব হিসাব-নিকাশ হচ্ছে একেবারে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পর্যায়ে। তৃণমূলে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা তালেবান তরুণটি নিজেও হয়তো জানেন না তাঁরা কারও ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন কিনা। তাঁদের কাছে এটা দ্বীন প্রতিষ্ঠার লড়াই।
আফগানিস্তানের দীর্ঘ সময় ধরে চলা ভূরাজনৈতিক দাবা খেলাটির একটি পর্যায় এখন দেখা যাচ্ছে এবং খেলাটি নিশ্চিতভাবেই এখানেই শেষ হচ্ছে না।
তালেবান-চীন পার্টনারশিপ অকল্পনীয় হওয়ার কথা ছিল না?
আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ক্ষমতা দখল করার ক্ষেত্রে তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক হিসেবে ছিল চীন। একসময় কিছুটা লুকোছাপা থাকলেও কাবুল দখলের বেশ আগেই এটা একেবারে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জুলাইয়ের শেষে তালেবানের শীর্ষ নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।
খবরটি নিশ্চয়ই অনেকের চোখে পড়েছে। কিন্তু কেউ কি আদৌ অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর (শিনজিয়াংয়ের উইঘুর) ওপরে সবচেয়ে বড় ব্যাপ্তি এবং মাত্রায় নিপীড়ন চালানো রাষ্ট্র চীন ক্ষমতা দখলের সাহায্য করছে চরম কট্টর শরিয়া শাসন চালু করবে, এমন একটা ইসলাম ধর্মভিত্তিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে? কিংবা বহু মানবাধিকার সংস্থার মতে, উইঘুর মুসলিমদের ওপরে গণহত্যার মতো অভিযোগে অভিযুক্ত একটি রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে কীভাবে তালেবানের মতো একটা কট্টর ধর্মভিত্তিক সংগঠন ক্ষমতায় যাওয়ার পথে দীর্ঘ লড়াই করেছে? কীভাবেই-বা তারা আগামী দিনগুলোতে চীনের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক পার্টনারশিপ তৈরির পরিকল্পনা করে?
ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখায় আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে চীনকে লাগবে আফগানিস্তানের, তালেবানের হিসাব কঠিন না। চীনের হিসাবও খুব সহজ, দৃশ্যমান।
আফগানিস্তান নিজের প্রভাবাধীনে থাকলে চীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরে নাশকতামূলক হামলার (বিশেষ করে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে) সম্ভাবনা অনেক কমে আসবে। ভূবেষ্টিত আফগানিস্তানের চীনের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ বর্ধিত হয়ে মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপে খুব সহজে চলে যেতে পারবে। আছে আফগানিস্তানের খনিজের বড় ব্যবসার সম্ভাবনা। এর মধ্যেই জানা গেছে আগামী বিশ্বের মূল চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ চালিত যানবাহনের ব্যাটারির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান লিথিয়ামের বিশাল এক মজুত আছে আফগানিস্তানে। একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ কপার প্রচুর পরিমাণে আছে আফগানিস্তানে। আছে অতি মূল্যবান খনিজ রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস।
এর মধ্যেই আফগানিস্তানে অবকাঠামো, খনি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় পরিমাণের চীনা বিনিয়োগের কথা জানা গেছে। এই বিনিয়োগ যখন সেখানে হবে, সেই বিনিয়োগকে রক্ষা করার জন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন এমন পদক্ষেপ নেবে, যাতে তার বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত থাকে। দেশটি চাইবেই যাতে অভ্যন্তরীণ কোনো অস্থিরতা তার বিনিয়োগকে সমস্যায় না ফেলে। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের সঙ্গে থাকা শিনজিয়াংয়ের খুব ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তটির নিরাপত্তাও চীনের কাছে জরুরি। স্বাধীনতাকামী উইঘুরদের সংগঠন ‘তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক পার্টি/ইস্ট তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট’-এর পক্ষে এই সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব। তাই নানা দিক বিবেচনায় একটা অনুগত তালেবান সরকার এই ব্যাপারে চীনকে নিশ্চিন্ত রাখবে।
একই ধরনের কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে পাকিস্তান, রাশিয়া ও তুরস্কেরও। সেদিকে আলোচনা না বাড়িয়ে কীভাবে কৌশলগত এবং অর্থনীতির লাভ-ক্ষতির হিসাব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা দেখা যাক আরেকটা দেশের উদাহরণ দিয়ে।
‘শত্রু’ ইরানও থাকবে আফগানিস্তানের পক্ষে?
সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত আফগানিস্তানের ১০ শতাংশের মতো মানুষ ‘হাজারা’, যাদের অল্প কিছু মানুষ সুন্নি হলেও প্রায় সবাই শিয়া। আগেরবার তালেবান যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন সুন্নি-শিয়ার আবহমান সংঘাত আফগানিস্তানেও চলে এসেছিল। সেই সময়ে এই গোষ্ঠীর ওপরে নানা হত্যাসহ নানা রকম অত্যাচার করেছিল তালেবানরা। কিন্তু এটা এখনো থেমে যায়নি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কয়েক দিন আগেই জানিয়েছে এই বছরের জুলাই মাসে ছয়জন হাজারাকে গুলি করে এবং আরও তিনজনকে শারীরিক অত্যাচার করে হত্যা করেছে তালেবান। শিয়া মুসলিমদের অঘোষিত নেতা ইরানের সঙ্গে তালেবানের ভীষণ খারাপ সম্পর্ক ছিল এই কারণেই। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, এই ইরানই থাকতে পারে শুরুর দিকে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর তালিকায়।
বিষয়টা আপাতদৃষ্টে অকল্পনীয় মনে হলেও একটা তথ্য যদি আমরা জেনে নিই তাহলে বুঝব ইরান কেন এখন তার ‘শিয়াদের রক্ষাকর্তা’ ইমেজ সরিয়ে রেখে ভিন্নভাবে ভাবছে। এই বছরেরই মার্চ মাসে ইরান চীনের সঙ্গে একটা কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির অধীনে চীন আগামী ২৫ বছরে ইরানে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এটা একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা, এই বিনিয়োগ অনেক বাড়তে পারে।
এভাবেই নানা দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৌশলগত কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থ এসে এক হয়েছে আফগানিস্তানে। আর সর্বোপরি আশরাফ গনি সরকারের পতনের পর আমেরিকা, ইউরোপের অনেক দেশ এবং ভারতকে আপাতত এক হাত দেখিয়ে দিতে পারা এই রাষ্ট্রগুলো অন্য দেশের সামনে বেশি শক্তিমান হিসেবে আবির্ভূত তো হবেই। এই বাক্যে ‘আপাতত’ শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, কারণ এই শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ব্যাপ্তিকাল ভীষণ রকম অনিশ্চিত।
এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে যেসব গোষ্ঠী, দল, উপদল পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত হয়েছে, সেগুলো আসলে পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক দাবা খেলার ঘুঁটির চাইতে বেশি কিছু না। তালেবানও এর চাইতে মোটেও আলাদা নয়। অন্য ঘুঁটির চাইতে তালেবান অন্য একদিক থেকে আলাদা, কারণ ঘুঁটি হিসেবে তালেবান অন্য ঘুঁটিগুলোর চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী।
তালেবানের অধীনেও আফগানিস্তান স্থিতিশীল হচ্ছে না
যে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে আমেরিকা, সেই তালেবানদের পূর্বসূরিদের আমেরিকাই তৈরি করেছিল, অস্ত্র, টাকা দিয়ে শক্তিশালী করে তুলেছিল আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই সময় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে যাওয়া লজ্জিত সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্তমানের মূল প্রতিনিধি রাশিয়া বিজয়ের হাসি হাসছে। এটাই স্বার্থের হিসাব, এটাই ভূরাজনীতি।
যাদের এই মুহূর্তে পরাজিত দেখাচ্ছে তারা সবকিছু ছেড়ে আর আফগানিস্তানমুখী কি হবে না? তারা কি পারবে অতি গুরুত্বপূর্ণ সব খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানকে তাদের ‘শত্রুদের’ হাতে রাখার ঝুঁকি নিতে?
গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ আর কমিউনিস্টবিরোধী যুদ্ধে অসম সাহসিকতার জন্য ‘পানশিরের সিংহ’ নামে খ্যাত শাহ আহমদ মাসউদের পুত্র আহমদ মাসউদ মিলে পানশিরে তালেবানকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই লেখা যখন লিখছি তখন আলোচনা অথবা আক্রমণ দুটো অপশন মাথায় রেখেই তালেবান পানশিরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। ইতিহাসে অতি দীর্ঘ সময় অজেয় থাকা পানশির কতটা লড়াই করতে পারবে, সময়ই বলবে। কিন্তু খুব দ্রুতই আফগানিস্তান অন্যান্য এলাকায় অস্থিরতার শিকার হয়ে পড়বেই। তালেবানের অধীনে আফগানিস্তান স্থিতিশীল হচ্ছে না ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কারণেই।
বর্তমানে আমরা এমন পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসা সরকারও নানা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের স্বার্থের সামনে তার নিজস্বতা রক্ষা, তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা নিয়ে প্রচণ্ড চাপ, ঝুঁকির মুখে পড়ে। সেখানে জবরদখল করে ক্ষমতায় থাকা একটি শক্তি শাসিত দেশের সেই ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেটের শক্তি না থাকা তালেবান টিকে থাকবে তার বিদেশি প্রভুদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে।
হ্যাঁ, তালেবানকে একটা জবরদখলকারী শক্তি, ভূরাজনৈতিক দাবা খেলার ঘুঁটির বেশি কিছুই মনে করি না আমি। দুঃখিত, তাদের বিজয় আফগান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পরাধীনতার শৃঙ্খল-ভঙ্গ করে মুক্ত হওয়া নয়; আরেক নতুন ভয়ংকরতর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক