তরুণেরা অবসর কীভাবে কাটায়?
বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপ করেছে প্রথম আলো। নানা বিষয় উঠে এসেছে জরিপে। জঙ্গিবাদ বিষয়ে তরুণদের ভাবনা, অবসরচর্চা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ধরন ইত্যাদি। দেশ কোন দিকে যাবে, এটা বোঝার জন্য তরুণদের চিন্তাধারা বোঝা জরুরি। ফলে গণমাধ্যম হিসেবে প্রথম আলোর এই জরিপ অত্যন্ত দায়িত্বশীল একটি উদ্যোগ।
তরুণেরা অবসর কীভাবে কাটায়? প্রথম আলোর এই জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৮০ শতাংশই বলেছে, তারা অবসরে টিভি দেখে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা বলেছে ৫০ শতাংশ। ৪৩ শতাংশ আড্ডা দেয় পরিবারের সঙ্গে। ঘুমিয়ে অবসর কাটায় ৪১ শতাংশ। সমানসংখ্যক তরুণ অবসর কাটায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংবাদপত্র পড়ে ৩১ শতাংশ। ৩০ শতাংশ বই পড়ে অবসরে। খেলা দেখে ২৪ শতাংশ, খেলা টিভিতে দেখে ২৩ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্রাউজ করে ২০ শতাংশ ইত্যাদি।
অবসর কাটানোর ধরন থেকে একটা জনগোষ্ঠীর চরিত্র নিবিড়ভাবে বোঝা যায়। বিশেষ করে, নিও-লিবারেল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিমানুষ নানাবিধ চক্করের মাঝে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বন্দী হয়ে থাকে। থাকতে হয় তাকে। ফলে তার বেশির ভাগ সময়ই স্বাধীনভাবে কাটানোর জন্য নয়। তার ওপরে, বাড়তি অর্জনের মোহে সে তার বাদবাকি সময়টুকুকেও ‘উৎপাদনশীল’ করে তুলতে চায়। ফলে পুঁজিবাদ জয়ী হয়। ব্যক্তিমানুষ পরাজিত হয়। সেই চক্কর থেকে কিছুটা সময় বাঁচিয়ে এনে চিত্তবিনোদনে খরচ যারা করে, তারা কিছুটা হলেও পুঁজির আগ্রাসন দমিয়ে রাখতে চায়। চিত্তবিনোদনের সময়টা তার স্বাধীন সময়। ওই সময়টা কাটানোর ধরন থেকে তাকে অনেকখানি নিবিড়ভাবে বোঝা সম্ভব। এর বাইরে, যেসব নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত হয়, সেগুলো যেহেতু পুঁজির চাকায় বাঁধা, সামাজিক আদব-লেহাজের সুতায় আটকানো, তার মাধ্যমে ওই ব্যক্তিটিকে বোঝার আশা তুলনামূলকভাবে ক্ষীণ। মোটামুটিভাবে এই যুক্তির ওপরই ক্রিস রোজেকসহ অন্যরা লেইজার স্টাডিজ বা অবসর-অধ্যয়ন নামক একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানকাণ্ড গড়ে তুলেছেন।
এ রকম একটি যুক্তি থেকেই আমি ঢাকার বস্তিবাসীর অবসর কাটানোর ধরন নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম ২০০৪ সালে। ফলে প্রথম আলোর এই অবসর-সংক্রান্ত জরিপ আমাকে আরও বেশি কৌতূহলী করেছে। বিস্ময়করভাবে, আমার গবেষণায়ও অবসর কাটানোর হাতিয়ার হিসেবে টেলিভিশন শীর্ষস্থান অর্জন করেছিল। আমার তথ্যদাতা ছিল তরুণ-প্রবীণনির্বিশেষে ঢাকা শহরের কয়েকটি বস্তির অধিবাসী। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসেনি। আমার গবেষণায় অবসরে গান শোনা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল। প্রথম আলোর গবেষণায় গান শোনাকে ক্যাটাগরি আকারে দেখিনি। টিভির পছন্দের অনুষ্ঠানের মধ্যে জরিপে সিনেমা জায়গা পেয়েছে এবং ৪২.৬ শতাংশ টিভিতে সিনেমা দেখে। তবে সিনেমা দেখা এই গবেষণায় আলাদা কোনো ক্যাটাগরি আকারেই আসেনি। টিভির বাইরেও ইউটিউবসহ নানাভাবে এখন তরুণেরা সিনেমা দেখে।জরিপে যেখানে ৩০ শতাংশ তরুণ বই পড়াকে তাদের অবসর কাটানোর উপায় হিসেবে উল্লেখ করেছে, সিনেমা দেখার কথা তার চেয়ে বেশি তরুণ উল্লেখ করত বলে আমার ধারণা। আজকালকার তরুণেরা সিনেমা দেখার চেয়ে বই বেশি পড়ে, এটাকেউবিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি–কোয়েস্ট নিশ্চয়ই এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেবে।
এ ধরনের জরিপ চালানোর পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা অনেক। এখানেও এর নানা নমুনা দেখা গেল। যেমন ‘টিভি দেখা’ একটা ক্যাটাগরি থাকা সত্ত্বেও ‘টিভিতে খেলা দেখা’ আরেকটি ক্যাটাগরি আকারে এসেছে। এটি প্রকারান্তরে ‘টিভি দেখা’ ক্যাটাগরিটাকে আরও প্রমিন্যান্ট করে। কিন্তু জরিপের ধরনের কারণে ওই বাড়তি ভ্যালুটাকে টেলিভিশনের সার্বিক ক্যাটাগরির ভেতর যোগ করে টেলিভিশনের ব্যাপকতাকে পরিসংখ্যানগতভাবে বোঝার সুযোগ নেই।
একইভাবে, ‘সংবাদপত্র পড়া’ বলতে অফলাইন নাকি অনলাইন সংবাদপত্রের কথা বোঝানো হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। যদি কেবলই অফলাইন বা প্রিন্ট ভার্সন পত্রিকার কথা জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তবে তা অনলাইন পত্রিকা পড়ার একটা ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। আবার যদি অনলাইন–অফলাইন উভয় মাধ্যমই বোঝানো হয়, তবে তা নিচের দিকে ‘ইন্টারনেট ব্রাউজিং’ ক্যাটাগরির জন্য সমস্যাজনক হয়ে ওঠে। ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ার ক্রিয়াকর্মকে সে ক্ষেত্রে ওই ক্যাটাগরি থেকে বাদ দিয়ে বাদবাকি ব্রাউজিংকে বিবেচনায় নিতে হবে।
সবচেয়ে আগে যেটা বোঝা জরুরি সেটা হলো, যোগাযোগমাধ্যমের চরিত্র বদলে গেছে। বর্তমান যুগ অভিসারী যোগাযোগমাধ্যমের যুগ। কোনো কিছুই আর এককভাবে কোনো মিডিয়ার কনটেন্ট আকারে থাকছে না। এখন ধরা যাক, টেলিভিশনের ঈদের নাটক যখন কেউ ইউটিউবে দেখছে, তার অবসর কাটানোর মাধ্যম কোনটা হলো? টেলিভিশন, নাকি ইউটিউব? ফেসবুকে যখন আপনি লাইভ ক্রিকেট সম্প্রচার দেখছেন, তখন কি টেলিভিশন দেখছেন নাকি ফেসবুক করছেন?
যা-ই হোক, এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোকে বাদ দিলে, তরুণদের অবসরের ধরন বোঝার এই উদ্যোগটিকে আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। অবসর হলো স্বাধীন সময়। যদিও এই স্বাধীনতারও রকমফের আছে। ভোগবাদী সংস্কৃতির ভেতর, লাগাতার বিজ্ঞাপনের কারসাজির চক্করে আমরা আসলে কতখানি স্বাধীনভাবে সময় কাটাতে পারি, সেও এক প্রশ্ন বটে। তবু মানুষ নিজের মতো করে অবসর কাটায় বা কাটাতে চায়, এই আকাঙ্ক্ষাটুকুকে অন্তত সন্দেহ করার উপায় নেই। তরুণদের বেলায়ও এটা সত্য। বেশি সত্য। কারণ, তার হাত-পা পুঁজিবাদের চাকার সঙ্গে এখনো অত শক্তভাবে বাঁধা নয়। ফলে তার অবসরের ধরন থেকে তার আকাঙ্ক্ষার জগৎটাকে বোঝার সুযোগ অনেক বেশি।
সুমন রহমান: কবি, গল্পকার ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক।