২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। প্রধানত দুটি বিষয়কে ঘিরে চলছে তর্ক—এ সিদ্ধান্ত কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব আর উচ্চশিক্ষার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কতটা গণতান্ত্রিক।
পরীক্ষা বাতিলের পক্ষ-বিপক্ষের সাতকাহন
প্রথম তর্কের এক পক্ষের দাবি হলো ঘ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিল হলে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের হয়রানি কমবে। তাঁরা এই ইউনিটের পরীক্ষায় না বসেও বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন! ধরা যাক, আমিনা ক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উদ্ভিদবিদ্যা পেলেন, কিন্তু তাঁর আগ্রহ নৃবিজ্ঞানে। সে ক্ষেত্রে তিনি নৃবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে পারবেন, যদি বিজ্ঞান শাখা থেকে ভর্তির আসনসংখ্যা পূরণ না হয়ে যায়। কাজেই এতে শিক্ষার্থীদের লাভ। বিপরীত পক্ষের দাবি হলো, ঘ ইউনিট তুলে দিলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ পরিচালিত ভর্তি পরীক্ষাটি না থাকলে প্রায় ১ লাখ শিক্ষার্থীর কেউ তাঁর নিজস্ব ইউনিটে যেমন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ক ইউনিটে বা কলার খ ইউনিটে সুযোগ না পেলেও ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছেন না আর।
আবার সেই আমিনার কথা বলি, ঘ ইউনিট না থাকলে ক ইউনিটের কোনো বিভাগ না পেয়ে পরীক্ষা ছাড়াই ইউনিট বদলে অর্থনীতি পড়তে চলে আসতে পারেন। তিনি অঙ্ক ভালো পারতে পারেন, কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানের পড়ার জন্য যে ভাষাগত দক্ষতা এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার, তা না-ও থাকতে পারে। আবার হয়তো আরেকজন খ ইউনিট থেকে অর্থনীতি পড়তে এলেন, মানবিক শাখার পড়ালেখা করে কিন্তু তার কোয়ান্টিটেটিভ স্কিল একেবারে কম। সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষাটা তাঁর জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠতে পারে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ বৈশিষ্ট্যগতভাবেই ইন্টারডিসিপ্লিনারি, অনেক বিভাগে গণিত এবং পরিসংখ্যান যেমন দরকার, তেমনি তাত্ত্বিকজ্ঞানও লাগে। শুধু তা-ই নয়, বৈশিষ্ট্যগতভাবে মোটাদাগে সামাজিক বিজ্ঞান ক্রিটিক্যাল জ্ঞানচর্চার বিদ্যায়তনিক পরিসর। তাই একজন শিক্ষার্থীর শুধু এইচএসসি পর্যায়ের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান দিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করা যায় না। এসব কিছু বিবেচনা করে এ অনুষদের সব শিক্ষকের গত তিন বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় ঘ ইউনিটের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মানকে উন্নত করেছেন, যাতে সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় মেধা যাচাই সম্ভব হয়। এটা খুব অজানা নয় যে গত বছরের ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সামাজিক মাধ্যমে কী রকম প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
পরীক্ষার বোঝা যদি সত্যি কমাতে চায় কেউ তাহলে উচিত হবে সব অনুষদের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটাই পরীক্ষা নেওয়া। একটাই মেধাতালিকা হবে, প্রশ্নের মধ্যে সব অনুষদের জন্য আলাদা করে মেধা যাচাইয়ের আলাদা প্রশ্ন থাকবে। এ ছাড়া তাদের উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল থাকবে। যে যে বিভাগে পড়তে চায়, মেধাতালিকা অনুযায়ী, বিভাগের রিকোয়েরমেন্ট অনুযায়ী চান্স পাবে বা পড়বে। হয় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন পরীক্ষা নিন, অথবা সব অনুষদের আলাদা পরীক্ষা থাকুক।
দ্বিতীয় তর্ক হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতন্ত্রচর্চার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। প্রশাসন পক্ষ এবং তাদের সমর্থিত শিক্ষকেরা দাবি করছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘ ইউনিটের পরীক্ষা পরিচালনাকারী সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকেরা তা মানতে নারাজ। উত্তীর্ণ প্রার্থীরা সামাজিক বিজ্ঞান ছাড়াও আরও কয়েকটি অনুষদে এবং ইনস্টিটিউটগুলোতে ভর্তি হয় বলে আপাতদৃষ্টে মনে হতেই পারে যে এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, ফলে কেন্দ্রীয় পর্যায়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সামাজিক বিজ্ঞানের কথা শুনতে হবে কেন? বলা বাহুল্য, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী আসে ঘ ইউনিটের মাধ্যমে। যেমন গত শিক্ষাবর্ষে এ অনুষদে ভর্তি মোট ১ হাজার ২০৭ জনের মধ্যে ৬১৪ জন শিক্ষার্থী এসেছেন ঘ ইউনিট থেকে। আবার ঘ ইউনিটে থেকে ভর্তি হওয়া মোট ১ হাজার ৫৭০ জনের প্রায় ৩৯ শতাংশ ভর্তি হয়েছেন এ অনুষদে, যা অনুষদগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ (কলা অনুষদে ৩৩ শতাংশ আর আইন অনুষদে মাত্র ৪ শতাংশ)। তাই সংখ্যার বিচারে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এই অনুষদের অনন্য ভূমিকার কারণে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তাদের নিজস্ব মতামত দেওয়ার অংশীদারত্ব অনেক বেশি।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ডিনস কমিটি (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে এ রকম কোনো কমিটির অস্তিত্ব নেই!) তাদের এক সভার একদম শেষের দিকে আলোচ্যসূচির বাইরে হঠাৎ করে ঘ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের মতো একটা মৌলিক বিষয়কে আলোচনায় নিয়ে আসে। পত্রিকা মারফত জানা গেছে যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন এই আলোচনায়। এরপর ৯ নভেম্বর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদের অনুষদীয় সভায় উপস্থিত ১৬টি বিভাগের সভাপ্রধান এবং অধ্যাপকদের সম্মতিতে ঘ ইউনিট তুলে না দিয়ে প্রয়োজনে সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য স্বতন্ত্র পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং নিয়মানুযায়ী তার প্রতিবেদন একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠানো হয়।
পরে ২৩ নভেম্বর সাধারণ ভর্তি কমিটির সভায় অ্যাজেন্ডাবহির্ভূতভাবে আবারও ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয় এবং সামাজিক বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে যথারীতি অসম্মতি জানানো হয়। তবে সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে বিভিন্ন অনুষদের আসনসংখ্যা পুনর্বিন্যাস লিপিবদ্ধ থাকলেও ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের কথা উল্লেখ ছিল না বলে জানা গেছে! তাহলে কিসের ভিত্তিতে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত হলো, যা একাডেমিক কাউন্সিলে উপস্থিত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকেরাও জানেন না বলে পত্রিকা মারফত আমাদের নজরে এসেছে। অর্থাৎ অংশীজনের এক অংশের (শিক্ষকদের) মতামত উপেক্ষিত এবং অন্য অংশের (শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের) কোনো মতামত না নিয়েই প্রতিবছর ১ লাখ শিক্ষার্থী আবেদন করেন এমন একটা পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? কোন গণতন্ত্রের বলে তাহলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?
ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের রাজনৈতিক অর্থনীতি
দুই পক্ষের তর্কাতর্কির বাইরে আরেকটি আলোচনা সম্ভবত আড়ালেই রয়ে গেছে এখন পর্যন্ত। আর তা হলো ভর্তি পরীক্ষার বাতিলের রাজনৈতিক অর্থনীতি। ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করেন অন্যান্য অনুষদের তুলনায়। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় হওয়া ভর্তি ফি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেই আসে এবং এ অর্থ দিয়েই পরীক্ষা পরিচালিত হয়। কলা অনুষদের ক্ষেত্রে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অর্ধেকের মতো। আবার আইন অনুষদ আলাদাভাবে পরীক্ষা নিতে পারে না, তাই তাদেরও এই ফরম বিক্রির আয়ে অংশীদারত্ব নেই। সবকিছু মিলিয়ে এটা অনুমান করা খুব কঠিন নয় যে এই আয়বৈষম্যই ঘ ইউনিটের বিলুপ্তির প্রধান কারণ। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা না থাকলে সামাজিক বিজ্ঞানের আয় নিঃসন্দেহে কমে গেলেও কলা বা আইন অনুষদের আয় যে বাড়বে, সেটার নিশ্চয়তা কী? তবে নাক তো কাটা গেল লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর আর যাত্রাভঙ্গ হলো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের!
পরীক্ষার বোঝা যদি সত্যি কমাতে চায় কেউ তাহলে উচিত হবে সব অনুষদের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটাই পরীক্ষা নেওয়া। একটাই মেধাতালিকা হবে, প্রশ্নের মধ্যে সব অনুষদের জন্য আলাদা করে মেধা যাচাইয়ের আলাদা প্রশ্ন থাকবে। এ ছাড়া তাদের উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল থাকবে। যে যে বিভাগে পড়তে চায়, মেধাতালিকা অনুযায়ী, বিভাগের রিকোয়েরমেন্ট অনুযায়ী চান্স পাবে বা পড়বে। হয় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন পরীক্ষা নিন, অথবা সব অনুষদের আলাদা পরীক্ষা থাকুক—নাম কী ‘ঘ’ হবে না ‘চন্দ্রবিন্দু’ হবে, সেটা নিয়ে কথা চলতে পারে, কিন্তু সরাসরি খ বা ক বা গ ইউনিট থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে বা আইনে ভর্তি হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্যই বেশি ক্ষতিকর হয়ে যাবে। যত দিন অভিন্ন পরীক্ষা না হচ্ছে, তত দিন ঘ ইউনিট বাতিল করা অনুচিত এবং এই পরীক্ষাকে বরং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের জন্য নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষায় পরিণত করা উচিত, যেখান থেকে চাইলে খ, গ ও আইন অনুষদ শিক্ষার্থী নিতে পারবে।
সামিনা লুৎফা এবং মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: লেখকদ্বয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক