প্রতিদিন সকালটা ফিলিস্তিনের শিশু আহমেদের শুরু হয় একটু পরই গুলির শব্দ হবে, এ শঙ্কা নিয়ে। আর অন্যদিকে ভারতের শিশু মালিনীর সকাল শুরু হয় অন্য রকম ভয় নিয়ে। তাকে ইনসুলিন নিতে হবে, চামড়া ভেদ করে রক্তাক্ত করে ইনসুলিন দেওয়া হবে; এ আতঙ্কে দিন কাটে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এই শিশুর। যুদ্ধ, সহিংসতা আর হানাহানিতে মানুষের মৃত্যু যেমন দিন দিন পৃথিবীকে করে তুলছে ভয়ংকর; তেমনি পৃথিবীতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ১০টি রোগ এ মুহূর্তে হয়ে উঠেছে আশঙ্কাজনক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ৪৫ কোটির অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অসংখ্য মানুষ এখনো অজ্ঞাত তাদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের মতে, প্রতি দুজন ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মানুষের মাঝে একজন জানেই না সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
আমেরিকান ডায়াবেটিস সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী প্রতি ২১ সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মানুষের আকস্মিক মৃত্যুর আশঙ্কা একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি। কানাডা সরকারের স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, এ মুহূর্তে প্রতি তিনজন মানুষের মাঝে একজনের জীবনের যেকোনো পর্যায়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ তথ্যগুলো আমাদের একটি বার্তাই দেয় আর তা হলো এখনই সময় ডায়াবেটিস নিয়ে ভাবার, ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানার।
আমাদের শরীরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন গ্লুকোজ তথা শর্করা। আর এই গ্লুকোজ যখন রক্ত থেকে কোষে পৌঁছায়, তখনই কোষ বিভিন্ন জীব রাসায়নিক পদার্থ যেমন প্রোটিন, চর্বি এসবের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া, শক্তি উৎপাদন, কোষের বিভাজন ও বৃদ্ধিসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে। আর রক্ত থেকে শর্করাকে কোষে পরিবহনের কাজটিই করে ইনসুলিন। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এ ইনসুলিন তৈরি প্রক্রিয়া
ব্যাহত হয়।
কারও ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না (টাইপ–১ ডায়াবেটিস), কারও ক্ষেত্রে ইনসুলিন তৈরি হয় প্রয়োজনের তুলনায় কম (টাইপ–২ ডায়াবেটিস), আবার কোনো ক্ষেত্রে ইনসুলিন তৈরি হলেও তা কোষে পৌঁছাতে পারে না বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় বা কোষের জটিলতার কারণে (টাইপ–২ ও অন্যান্য ডায়াবেটিস)। তখনই রক্তে অতিরিক্ত শর্করা বা গ্লুকোজের উপস্থিতি দেখা যায়। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হয় বিভিন্ন নিয়মিত শারীরিক প্রক্রিয়া। দেখা দেয় বহুমূত্র রোগ, অতিরিক্ত ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দুর্বলতা, চোখে ঝাপসা দেখা ও খুব সহজে কিছুদিন পরপর রোগজীবাণুর সংক্রমণ।
এর কারণ কী? ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা, কম শারীরিক কর্মকাণ্ড, পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদান এবং বংশগত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত অস্বাভাবিকতা। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিসের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ ২–জাতীয় ডায়াবেটিসে এবং বিশ্বে বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক লোক এই প্রকার ডায়াবেটিসে ভুগছে। প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে ডায়াবেটিসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত কোনো কারণে।
তাহলে প্রশ্ন হলো ডায়াবেটিসের কি কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। সুস্থ জীবনযাপন। অতিরিক্ত চিনি কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা, হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা, অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুড ও অতিরিক্ত মদপান পরিহার করা।
আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। বলা হয়ে থাকে ব্যাংকঋণ যেমন একটা পরিবারের বোঝা, তেমনি ডায়াবেটিসও একজন ব্যক্তির পুরো পরিবারের বোঝা, যদি তা নিয়ন্ত্রণ করা না হয়। প্রতিবছর বিশ্বে ৬০ হাজার কোটি ডলার খরচ হয় ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা, ব্যবস্থাপনা আর ওষুধ ক্রয়ে। তাই এবারের ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘ডায়াবেটিস, প্রতিটি পরিবারের উদ্বেগ। আপনি কি প্রতিরোধ করছেন?’ পরিবারই পারে একজন মানুষের সুস্থ জীবনযাপনে সাহায্য করতে, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে, অতিরিক্ত ওজন ও অন্যান্য বিষয়ে সতর্ক থাকতে, নিয়মিত ওষুধ সেবনে সচেতন রাখতে।
প্রতিটি পরিবারকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। এ বিষয়ে সরকার, চিকিৎসক, গবেষক, শিক্ষক, ধর্মগুরু, সমাজকর্মী, সাংবাদিকসহ সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী প্রতি পাঁচজনের মাঝে একজন পরিবারের সদস্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে অবহিত। কবির মতো বলতে হয়, রাত পোহাবার আর কত দেরি? বাস্তবতা হলো আমাদের অনেক দূর যাওয়ার বাকি। এখনো ৭৫ শতাংশের বেশি পরিবারের সদস্যদের ডায়াবেটিসের তীব্রতা, নিয়ন্ত্রণ ও তার ভূমিকা নিয়ে সচেতন করা বাকি।
ডায়াবেটিসের রং দেওয়া হয়েছে আকাশি নীল আর প্রতীক হিসেবে আছে বৃত্ত। এই নীল আকাশের মতো সবাইকে ধারণ করে। আর অন্যদিকে বৃত্তটি হলো পৃথিবীর সব মানুষ ডায়াবেটিস-আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এবং ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতীক। পৃথিবীতে অনেক কিছু বদলাবে, তবে আমাদের শুরু এবং শেষটা কিন্তু পরিবারেই। ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মানুষের হতাশা, আতঙ্ক আর কষ্টের মতো আবেগী মুহূর্তগুলোতে সবার আগে পাশে দাঁড়াতে পারে পরিবার। পরিবার অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না–ও হতে পারে, কিন্তু এটাই একজন মানুষের সত্যিকারের পৃথিবী। প্রতিটি পরিবার হোক ডায়াবেটিসের প্রকোপমুক্ত।
আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক এবং ডায়াবেটিক গবেষক।