ডা. সৈয়দ আবদুল হাই চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে। তাঁর কর্মজীবন ছিল বেশ বৈচিত্রপূর্ণ।
কয়েক বছর জাতিসংঘের মেডিকেল টিমের সদস্য হিসেবে আফ্রিকা ও ঘানায় কর্মরত ছিলেন।
তিনি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতবাদ পোষণ না করলেও সচেতন ছিলেন। একাত্তরে কর্মরত ছিলেন যশোর সেনানিবাসে ৭ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের অধিনায়ক (সিও) হিসেবে।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে কালো পতাকা লাগিয়ে সেনানিবাসে ঢুকছিলেন।
সেনানিবাস গেটে পাকিস্তানি সেনারা কালো পতাকাসহ গাড়ি প্রবেশে আপত্তি জানায়। তিনি তা অগ্রাহ্য করে কালো পতাকাসহ সেনানিবাসে ঢোকেন।
এ কারণে তিনি পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হন। ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার মিথ্যা কথা বলে তাঁকে ব্রিগেড সদর দপ্তরে ডেকে নেয় এবং ওই দিনই তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় ডা. সৈয়দ আবদুল হাইয়ের সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী ডা. সুলতান আহমেদের (পরে কর্নেল) রচনা থেকে।
তিনি লিখেছেন, ‘৩০ মার্চ সকাল আটটায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সপ্তম ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সকে অস্ত্র সমর্পণ করার আদেশ দেওয়া হয়।
এতে বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা অস্ত্র সমর্পণ করতে আপত্তি করলে তাদের ওপর পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন দিয়ে আক্রমণ করা হয়।
বাঙালি সৈনিকরা পাকিস্তানিদের প্রতিহত করতে থাকে। ‘ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের অফিসারের মধ্যে ক্যাপ্টেন আবুল কালাম শেখ ছাড়া সবাই ছিল ডাক্তার।
লে. কর্নেল হাই কমান্ডার, আমি সেকেন্ড ইন কমান্ড। সকাল ১০টার দিকে গোলাগুলি শুরু হলে হলে আমরা সবাই আমাদের অফিসকক্ষে অবরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
সদর দরজা বন্ধ ছিল। বেলা আড়াইটা-তিনটার দিকে সদর দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা। ওরা [পাকিস্তানি সেনা] বলছিল যে, আটক অফিসারদের তারা উদ্ধার করতে এসেছে।
আমরা করিডর দিয়ে অগ্রসর হলাম। প্রথম সারিতে ডা. হাই ও ক্যাপ্টেন শেখ। দরজা খোলার সাথে সাথে কমব্যাট ড্রেস পরিহিত দুজন ও অপরিচিত কয়েকজন অস্ত্রধারী তাদের গুলি করে।
আমরা বাকিরা ভয়ে বিহ্বল হয়ে পেছনে ছুটে এসে দুটি কামরায় বন্দী হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
কিন্তু কেউ কামরায় এসে আমাদের গুলি করল না।
‘সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। এরপর পাকিস্তানি সৈনিকরা এসে আমাদের ধরে নিয়ে যায়।
পরে এসকর্ট করে আমাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। সেখান থেকে লে. কর্নেল হাইয়ের মৃতদেহসহ আমাকে যশোর এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
মিসেস হাই, তাদের তিন ছেলে ও আমাকেসহ মৃতদেহটি একটি ট্রান্সপোর্ট প্লেনে ঢাকায় পাঠানো হয়।’ (পরিমার্জিত।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ, বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ, প্রকাশ ২০০৯)।
সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে আরও জানা যায় ডা. সৈয়দ আবদুল হাইয়ের স্ত্রী নাসিম হাইয়ের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে।
তিনি লিখেছেন, ‘৩০ মার্চ সকাল সাতটা। বেজে উঠল আমাদের বাসার টেলিফোন। অফিসিয়াল মেসেজ।
সেনানিবাসে সিপাহিরা গন্ডগোল করছে। এদের নিবৃত্ত করে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করার জন্য ডেকে পাঠানো হলো কর্নেল হাইকে।
পোশাক পরে অতি ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পথে আমি চেয়ে থাকলাম।
কোথাও কোনো কোলাহল ছিল না। শান্ত পরিবেশ। কিন্তু একটা অজানা শঙ্কা আচ্ছন্ন করে রাখল আমাকে।
‘সময়ের কাঁটা যেন আর এগোচ্ছে না। দুপুর বারোটার ঘরে ঘণ্টার কাঁটা এসে থামল একসময়। এর অল্পক্ষণ পরেই ডাক পড়ল আমাদের।
আশেপাশের অন্যান্য বাসা থেকেও ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো বাঙালি পরিবারগুলোকে এবং জড়ো করা হলো দাউদ পাবলিক হাইস্কুলে।
সবার মধ্যেই দারুণ উৎকণ্ঠা। ওখানে পৌঁছার পর পাকিস্তানি অফিসারদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছে যেন আমরা কেয়ামতের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছি। সময় যেন আর কাটতে চায় না।
ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠছে সমস্ত শরীর। বাচ্চারা বারবার জড়িয়ে ধরছে আমাকে।
জানতে চাচ্ছে তাদের আব্বু কোথায়? এই সময় হঠাৎ করে কানের পর্দায় আছড়ে পড়ল গোলাগুলির আওয়াজ।
দ্রাম দ্রাম শব্দ কাঁপিয়ে তুলল অফিস এলাকা। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল ওই দিকটা। থরথর করে কাঁপছে যেন ঘরবাড়ি।
তার সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁপছি আমরা।’ (সূত্র: ওই)।
সৈয়দ আবদুল হাইয়ের জন্ম শেরপুর জেলা শহরের মিয়াবাড়িতে। বাবা সৈয়দ আফরুজউদ্দিন, মা আসিয়া খাতুন।
১৯৩৭ সালে শেরপুরের গোবিন্দপুর পিস মেমোরিয়াল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৪০ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন।
এরপর লিটন মেডিকেল স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। পরে ভর্তি হন কলকাতা মেডিকেল কলেজে।
পড়াশোনা শেষে যোগ দেন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে। সৈয়দ আবদুল হাই তিন ছেলে সৈয়দ আশফাক হাই, সৈয়দ আদেল হাই ও সৈয়দ আরেফ হাইয়ের জনক। তাঁরা সবাই প্রবাসী।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]