ক্যাপিটল ভবনে হামলায় উসকানি দেওয়ার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রতিনিধি পরিষদ অভিশংসিত করার পরও মার্কিন সিনেট তাঁকে দণ্ডিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় একটি প্রশ্ন সবার সামনে ভেসে উঠেছে। সেটি হলো সংবিধানবিরোধী কিছু করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা আসলে কতটুকু আছে?
যুক্তরাষ্ট্র নামক রাষ্ট্রটি যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই মহান নেতারা এমন ব্যবস্থা রেখে যেতে চেয়েছিলেন, যাতে কোনো প্রেসিডেন্ট তাঁর গদিকে ব্যবহার করে ‘রাজা’ বনে যেতে না পারেন। কিন্তু ট্রাম্পের শাসনামলে আমরা আমেরিকার সংবিধানের হৃৎপিণ্ডকে লক্ষ্য করে ছুরি ধরতে দেখলাম। আমরা দেখলাম, একজন প্রেসিডেন্ট তাঁর পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করলেন এবং বিজয়ী প্রতিপক্ষকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণার প্রক্রিয়া বানচালের জন্য উন্মত্ত জনতাকে প্রতিপক্ষের ওপর শারীরিকভাবে আক্রমণ করার জন্য উসকানি দিলেন।
আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা সিনেটের হাতে অভিশংসিত প্রেসিডেন্টকে দণ্ডিত এবং গদি থেকে উৎখাত করার ক্ষমতা দিয়ে গেছেন। এর জন্য সিনেটের দুই–তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হয়। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করতেন, একটা দোদুল্যমান জনমতের ওপর ভিত্তি করে একজন প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা যায় না। সিনেটে দোষী সাব্যস্ত হওয়া অবশ্যম্ভাবী জেনে রিচার্ড নিক্সনের গদি ছাড়ার ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত আর কোনো প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করে অপসারণের ঘটনা ঘটেনি।
সিনেটে রিপাবলিকান নেতারা ট্রাম্পকে দণ্ডিত করার পক্ষে ভোট দেননি। দলের নেতা যত বড় অপরাধই করুন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে সিনেটে দলীয় সিনেটরদের যাওয়া ঠিক হবে না—এমন একটি ধারণাই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করলেন। এতে অভিশংসনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে কমেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই
প্রথমবারের মতো ১৮৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন প্রায় অপসারণের মুখে পড়েছিলেন। এর অনেক পরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সরকারের প্রধান কৌঁসুলি আর্কিব্যাল্ড কক্সকে অপসারণ করার জন্য যখন একের পর এক সরকারি কৌঁসুলিদের বরখাস্ত করা শুরু করলেন, তখন দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসনের কথাটি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এল। একজন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা হবে—এই বিষয় সবার কাছে তখন মহাবিস্ময় ও চরম ভীতিকর ধারণা হিসেবে ধরা দিচ্ছিল। কিন্তু এ ঘটনার অত্যন্ত দ্রুততায় অভিশংসনের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ জনমনে সহজ বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল।
১৭৮৭ সালে যখন সংবিধান লেখা হয়, তখন আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা অভিশংসনকে যে পরিপ্রেক্ষিতের সমাধান ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সেই পরিপ্রেক্ষিত একেবারেই পাল্টে গেছে। ওই সময় সত্যিকার অর্থে এখনকার মতো রাজনৈতিক দল ছিল না। সংবিধানপ্রণেতারা তখন জাতিকে বিভক্তকারী সম্ভাব্য ভয়াবহ দলাদলির ভয় থেকে এ অভিশংসনের ধারণা রেখেছিলেন।
ওই সময় অঙ্গরাজ্যগুলো মূলত গ্রামভিত্তিক জন অধ্যুষিত এলাকা ছিল। এসব এলাকার নাগরিকেরা অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিলেন। এই রক্ষণশীল নাগরিকদের নেতারা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সমর্থকদের মধ্যে ওই নেতাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গদিতে রাখার অভিলাষ জাগ্রত হতে পারে। সেই অভিলাষকে নিয়ন্ত্রণের আগাম ব্যবস্থা হিসেবে অভিশংসনের অনুচ্ছেদটি সংবিধানে রাখা হয়েছিল।
অভিশংসন ইস্যুতে ট্রাম্প এবং নিক্সনের সময় ও ঘটনাবলির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। নিক্সনের সময় রিপাবলিকান পার্টির নেতারা যখন তাঁকে বলেছিলেন অভিশংসন প্রস্তাব সিনেটে উঠলে তাঁরা হেরে যাবেন এবং সে কারণে নিক্সনের সরে যাওয়া উচিত, তখন নিক্সন বিনা তর্কে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন নিক্সনের অপসারণ দাবি করা জনগণকে কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু এই আমলে আমরা দেখলাম, যখন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা লিজ চেনি (সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে) বললেন, ট্রাম্প সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব উঠলে তিনি সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবেন, তখন তাঁকে ট্রাম্প এবং ট্রাম্প সমর্থকদের আক্রমণের মুখে পড়তে হলো। ট্রাম্প যুদ্ধবাজ নেতার মতো বলতে লাগলেন, তিনি এ ফল মানেন না এবং তাঁর উসকানিতে তাঁর সমর্থকেরা ক্যাপিটল ভবনে হামলা করে বসলেন।
এরপরও সিনেটে রিপাবলিকান নেতারা ট্রাম্পকে দণ্ডিত করার পক্ষে ভোট দেননি। দলের নেতা যত বড় অপরাধই করুন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে সিনেটে দলীয় সিনেটরদের যাওয়া ঠিক হবে না—এমন একটি ধারণাই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করলেন। এতে অভিশংসনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে কমেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● এলিজাবেথ ড্রু ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক ও লেখক