হামিদা বানু ছেলের খোঁজে প্রার্থীর বাড়ির বাইরের উঠানে বসে চোখ মোছেন। আগের দিন বিকেলে এ বাড়িতে আসার কথা বলে এক সাবেক ইউপি সদস্যের সঙ্গে চলে আসে তাঁর উচ্চমাধ্যমিকে পড়া ছেলে। থাকত যশোরে। কলেজে পড়ে, মেসে থাকে। পইপই করে না করেছিলেন হামিদা বানু, ‘ভোটের হ্যাপার মধ্যে গিরামে আসিস নে বাপ।’ কিন্তু কী করবে ছেলে? মেস বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। কোথায় আর যাবে, তাই বাড়িতে এসেছে।
ছেলের মোবাইল বন্ধ রাত থেকে। রাতে প্রার্থীর বাড়ি পুলিশের খানা-তল্লাশির খবর হামিদা বানু পান ফজরের সময়। সারা রাত ছেলের অপেক্ষায় দোয়া ইউনুস পড়েছেন, রাতের ভাত এখনো ঢাকা দেওয়া আছে। ‘তুমি কি আমার মানিকেক দেখিচো?’ একটাই কথা তাঁর মুখে। কলিজা যেন বেরিয়ে আসছে সেই কথায়। মেস বন্ধ করে দিলে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে মামা বাড়ি চলে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন ছেলেকে। ‘ম্যালা খরচ; ফেরত আসা লাগবি না। তোর ভাই কি খরচ দেবে? যদি না দেয় ত্যাখুন?’ এসব কথা কান্নার সুরে সুরে বয়ান করে চলেছেন হামিদা বানু। ছেলের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার বয়ান। সে বয়ানে দিনক্ষণের কোনো যতিচিহ্ন নেই, সব মিলেমিশে একাকার।
হামিদা বানুর বয়স যখন ১০-১২ বছর, তখন তাঁর বাবা শহীদ হন, সেটা ’৭১ সালের কথা। ২৬ নভেম্বর ভোররাতে শৈলকূপার প্রত্যন্ত গ্রাম কামান্নার যুদ্ধে নিহত হন তিনি। লাশ মেলেনি। ৭৩/৭৪ সালে দেখছেন রক্ষীবাহিনী-গণবাহিনীর নৈরাজ্য। ৭৫-এর পর গণবাহিনীর দলছুট অংশের হয়রানি, চাঁদাবাজি আর গুম খুনের আতঙ্ক। বাবার মৃত্যুর পর হামিদা বানুরা যে মামার আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন সেই মামার এক ছেলেকে স্থানীয় মস্তফা বাহিনীর লোকজন একদিন রাতে ধরে নিয়ে যান। আর ফিরে আসেননি। ঘরপোড়া গরুর দশা এখন তাঁর। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে হামিদা বানু শৈলকূপার কুমার নদের ধারে কামান্না গণকবরে যান। আগে যেতেন মার সঙ্গে, তারপর স্বামীর সঙ্গে, স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলের সঙ্গে। এ বছর যাওয়া হয়নি। হামিদা বানুর গ্রাম মনোহরপুর থেকে কামান্না এখন অনেক দূর মনে হয়। ছেলেকে নিয়ে আজ তাঁর সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। এখন ছেলেকে খুঁজে দেবে কে ?
হামিদা বানুর পাশে জটলাটা বড় হতে থাকে। প্রার্থীর বন্ধু, আত্মীয়, সমর্থকেরা মহা সমস্যায় পড়েছেন—পোলিং বুথের জন্য এজেন্ট হতে কেউ খোলা দিলে রাজি হচ্ছেন না। কাল পর্যন্ত যাঁরা নিমরাজি ছিলেন, আজ সকাল থেকে তাঁরা একদম চুপসে গেছেন। কাল রাত (২৬/১২) একটার দিকে পুলিশ এসে সারা বাড়ি তল্লাশি চালায়। তাদের অভিযোগ, নানা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিরা প্রার্থীর আশ্রয়ে তাঁর বাড়িতে লুকিয়ে আছেন। ভোটের আগে প্রার্থীর বাড়িতে, ক্যানভাস ক্যাম্পে লোকজনের আনাগোনা বাড়ে। পোস্টার, দড়ি আঁটা, মাইক, ব্যাটারি, চোঙ্গা, হাতমাইক ইত্যাদির হিসাবনিকাশ চলে অনেক রাত পর্যন্ত। খাই খরচ, যানবাহনের দেনা-পাওনার ঝুটঝামেলা নিয়ে সালিস চলে কখনো কখনো। কিন্তু যে প্রার্থী মাঠে নামতে পারছেন না, যাঁর কোনো পোস্টার ক্যাম্পেইন নেই, তাঁর বাড়ির রাস্তায় উঠানে বৈঠকখানায় লোকের জটলা থাকবে কেন? পুলিশ কি সেই অঙ্কের উত্তর খুঁজতে রাতদুপুরে ছুটে এসেছিল, না স্রেফ আতঙ্কের পারদটা উসকে দেওয়ার জন্য কারও ইশারার চাকা হয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে চলে এসেছিল?
(ফেসবুক মারফত জানা গেল, নো-ভ্যাট ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মীর বাড়িতে একইভাবে মধ্যরাতে হানা দিয়েছে পুলিশ। দরজা ভেঙে ঢুকে হয়রানি করেছে তাঁর মা ও বোনকে। ছেলে ভাগ্যিস বাড়ি ছিল না। এই ছেলেটির বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে জানা গেছে)
নির্বাচন কমিশনের কাগজপত্র অনুযায়ী ঝিনাইদহ-১ আসনে তিন প্রার্থী—হাতপাখা, ধানের শীষ আর নৌকা। ১০ ইউনিয়ন আর এক পৌরসভার উপজেলা শৈলকূপা নিয়ে ঝিনাইদহ-১ আসন। একসময় এই আসনে জাসদের খুব দাপট থাকলেও এখন তা ইতিহাস। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এখানে জাসদ প্রার্থী জয়লাভ করলেও ১৯৯১-এর নির্বাচনে জাসদের সেই একই প্রার্থী পান মাত্র চার হাজারের মতো ভোট। জামায়াতের প্রার্থী পান তাঁর দ্বিগুণেরও বেশি। সেই ভোটে জেতেন বিএনপির প্রার্থী। আওয়ামী লীগ থাকে দ্বিতীয় স্থানে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে ফলাফলের কোনো পরিবর্তন হয় না। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন করলে মাত্র ৩০০ ভোটের ব্যবধানে আসনটি পেয়ে যায়। সেই থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হাই আসনটি ধরে রেখেছেন।
বিএনপিও এবার প্রার্থী বদল করেছে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসাদুজ্জামান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে শামিল হয়েছেন। ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন। নির্বাচনের রায় রায়হান উদ্দিনের পক্ষে যাবে বলে তাঁর সমর্থকেরা মনে করলেও তাঁদের কোনো নির্বাচনী ক্যাম্প শৈলকূপা পৌর এলাকায় চোখে পড়েনি। তবে তাঁদের পোস্টার আর মাইক্রোবাসের চলাচল ছিল। ধানের শীষের কোনো পাত্তা নেই। ভটভটিচালক ওসমান মিয়া জানান, ওদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না।
ওসমান মিয়া মজার মানুষ, এক অর্থে জীবন্ত ইতিহাস। সব ইলেকশনের হিসাব তাঁর মুখস্থ। তেমাথার মোড়ে চা-শিঙারা খেতে খেতে জানান অঞ্চলের খবরাখবর। একসময় তার নেতা ছিলেন মস্তফা। মস্তফার কথায় জান দিতে পারতেন একদিন। ৮ নম্বর সেক্টরের গেরিলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন মস্তফা। নিজের ওজনের চেয়ে মানুষের ওজনের কথা বেশি মনে রাখতে হয়। তা না করলে সব ফানুস হয়ে দূরে চলে যায়। তখন যে পার্টিই ধরো না কেন, তুমি জিরো। আওয়ামী লীগ, জাসদ, জাতীয় পার্টি, কুলা মার্কার পার্টি, কত কিছু করলেন কিন্তু কূলে আর ভিড়তে পারলেন না। ১৯৭৯-এর এমপি ২০০৮ সালে পান মাত্র ১০৩ ভোট।
অ্যাডভোকেটের বাড়িতে না গেলে বোঝার কোনো উপায় ছিল না ঝিনাইদহ-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের কোনো অস্তিত্ব আছে কি না, প্রার্থী কি জীবিত না পলাতক। ঝিনাইদহের পাশের জেলা কুষ্টিয়া-১ আসনের প্রার্থী জেলহাজত থেকে ছাড়া পেলেও তাঁর গতি ও অবস্থানের কোনো হদিস নেই। কেউ জানে না কোথায় তিনি।
নির্বাচনের ফল যা হয় হোক, কিন্তু মায়ের ছেলেরা সবাই ঘরে ফিরে আসুক, সন্তানেরা ফিরে পাক তাদের বাবাকে।
(লেখায় ব্যবহৃত সব নাম ছদ্ম)
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।