প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যাচ্ছিলাম মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে। প্রচণ্ড জ্যামে বিজয় সরণিতে দীর্ঘ সময় আটকে থাকলাম। জ্যাম এখন ঢাকার নগর সংস্কৃতির অংশ, হয়তো ভবিষ্যতে এটি ঢাকার ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্তও হতে পারে। পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে জ্যামে আটকা পড়লে মানুষ এখন আর অস্থির হন না, চালক ঘন ঘন হর্নও বাজান না, সবাই ধৈর্য ধরেই বসে থাকেন। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
সবুজসংকেত জ্বলে ওঠার পর বাঁধভাঙা পানির মতো সব গাড়ি একসঙ্গে ফোয়ারা পেরিয়ে পশ্চিমে মোড় নিতে শুরু করেছে। গাড়ির হুড়োহুড়ি লেগে গেল, কে কার আগে যাবে। মোড় নিয়েই সামনে দেখি, আমাদের দিকের রাস্তার ডান প্রান্ত ঘেঁষে একটা দোতলা বাস উল্টো দিক থেকে, অর্থাৎ পশ্চিম দিক থেকে ফোয়ারার দিকে আসছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের বাস। বাসের মুখোমুখি হয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের দিকের চলমান গাড়ির একাংশ। বাসের সামনে সামনে হেঁটে আসা পাঁচ-ছয়জন ছাত্র আমাদের দিকের গাড়িগুলোকে বাঁয়ে চেপে যাওয়ার ইঙ্গিত বা নির্দেশ দিতে থাকল। আমরাও তা মেনে নিয়ে উল্টো দিক থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বাসটি সসম্মানে যাওয়ার সুবিধা করে দিলাম। এ ঘটনায় বাসে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম না, তাদের নির্বিকার দেখাচ্ছিল। মনে হলো না যে তারা কাজটিকে বেঠিক মনে করছে। বরং মনে হলো, বোধ হয় এটিকেই তারা সঠিক বিশ্বাস করছে।
আজ যদি জ্যামে আটকে থাকার কষ্ট ছাত্ররা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে না নিতে পারে, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় আত্মত্যাগের প্রশ্ন এলে তারা কী করবে
বিষয়টি অবশ্য আমাকে খুব পীড়া দিল। মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম, আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কি ঠিক পথে আছে! এর কিছুদিন পর একই ধরনের ঘটনা লক্ষ করলাম শাহবাগ-বাংলামোটর সড়কে। জ্যামের কারণে উত্তর দিকগামী সব যানবাহন বাঁয়ের রাস্তায় স্থির হয়ে আছে। আর নিয়ম ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলা বাসগুলো রাস্তার ডান দিক দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছে, একটার পর একটা। সময়টা ছিল অপরাহ্ণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ হয়েছে কেবল। বাসগুলোর উল্টো পথে চলাচলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বরত পুলিশ ও সার্জেন্টদের নিরাসক্ত মনে হলো। ঈষৎ গুঞ্জন ছাড়া আমাদের দিকে আটকে পড়া মানুষের মধ্যেও কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম না।
এটা পরিষ্কার হলো যে এ ধরনের ঘটনা তাঁরা নিয়মিতই দেখে আসছেন। ছাত্রদের বাস সামনে জ্যাম দেখলেই উল্টো পথে চলা শুরু করে। দেখে মনে হচ্ছিল, সবার কাছে এই অনিয়ম আর অন্যায় গা-সওয়া হয়ে গেছে। ছাত্ররা জাতির ভবিষ্যৎ। এই জাতির ভবিষ্যতেরা উল্টা পথেই চলবে, এটাই কি তবে রেওয়াজ হয়ে গেছে? আর আমরা সবাই তা মেনেও নিয়েছি। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, অনেক গাড়িই তো উল্টো পথে চলে। সমস্যাটা আসলে সেখানেই। পতাকা ও তারকাখচিত গাড়ি, উচ্চপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের গাড়ি, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি, আর হালে হুটার বাজানো দামি গাড়ি তো সামনে জ্যাম দেখলেই উল্টো পথে চলা শুরু করে। ছাত্ররা তো শুধু এসব নেতা, ক্ষমতাবান বা সম্মানিত ব্যক্তিদের অনুসরণ করছে মাত্র।
সম্প্রতি ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে একজন তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এবং ছাত্রদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিক্ত অভিজ্ঞতা বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অন্যদের দেওয়া মন্তব্যগুলোর বেশির ভাগে ছাত্রদের দোষারোপ করলেও কেউ কেউ শিক্ষকদেরও দোষারোপ করেছেন। টিভিতে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন টক শোতে কোনো না-কোনো শিক্ষক প্রতিদিনই দেশ, জাতি ও সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ও অন্যায় নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা সেখানে সব অন্যায় ও অসংগতি দূরীকরণের ফর্মুলাও দেন। কোনো বিষয় অপছন্দ হলে শিক্ষকদেরও পত্রিকায় একযোগে বিবৃতি দিতে বা প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতেও দেখি। কিন্তু এমন কোনো সংবাদ, বিবৃতি বা আলোচনায় আমরা ছাত্রদের এই অন্যায় বা অসংগতির বিষয়ে তাঁদের কখনো কোনো বক্তব্য দিতে শুনিনি। প্রশ্ন জাগে, জাতির ভবিষ্যতের এই উল্টো পথে চলায় শিক্ষকদেরও কি মৌন সম্মতি আছে?
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহার নিয়ে আন্দোলন করেন। তাঁদের আন্দোলন অহিংস হলেও, সারা শহরে আন্দোলন ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে শহরের যান চলাচলব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। এ রকম একটি অস্বাভাবিক ও অসহনীয় পরিস্থিতিতেও শিক্ষার্থীদের বাস উল্টো পথেই চলাচল করেছে। সারা দেশের মেধাবী ছাত্রদের একটা বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এটি দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে দেশে আরও বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু মেধা ও সংস্কৃতির জগতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখনো শীর্ষে। এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দেশের সবচেয়ে অগ্রগামী তরুণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। দেশের সব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব আগে থেকেই স্বীকৃত। তাদের কর্মকাণ্ড দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও প্রভাবিত করে।
অহরহই উচ্চারিত হচ্ছে যে আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পতাকা ছাত্রদের তথা নতুন প্রজন্মের হাতে সমুন্নত থাকবে। আজ যদি জ্যামে আটকে থাকার কষ্ট ছাত্ররা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে না নিতে পারে, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় আত্মত্যাগের প্রশ্ন এলে তারা কী করবে? তখনো কি উল্টো পথ ধরে অন্যদের ফেলে রেখে সরে পড়বে?
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।
[email protected]