২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

চীনে জ্যাক মার প্রতিষ্ঠানও ধরাশায়ী হলো

জ্যাক মা

চীনের আর্থিক খাতের ওপর দেশটির সরকারের নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সমালোচনা করে গত অক্টোবরে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। তারপরই পুরো চীনের অনলাইনভিত্তিক আর্থিক খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ঝড় বয়ে গেছে। আলিবাবার সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট গ্রুপ যাত্রা শুরু করার মাত্র দুই দিন আগে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ট গ্রুপের পূর্বনির্ধারিত আইপিও স্থগিত করে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো চীনের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।

চীনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়গুলো ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা এখন কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। অতীতে চীন ‘একটি ব্যাংক ও তিনটি কমিশন’ এই কাঠামো ব্যবহার করে আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি) মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ ও ম্যাক্রোপ্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে ছিল। অন্যদিকে আলাদা ব্যাংক ও বিমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং চায়না সিকিউরিটিজ রেগুলেটরি কমিশন (সিএসআরসি) নিজ নিজ সংশ্লিষ্ট খাত নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু এই তিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনধিকার চর্চা এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে কিছু অন–আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও নিয়ন্ত্রণ সালিসিতে আর্থিক বিবাদ নিরসন ও বিতর্কসংক্রান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুবিধা অনুমোদন করা হয়। আনবাং ইনস্যুরেন্স গ্রুপ এবং টুমরো গ্রুপের দুটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির পর সরকার কয়েকটি সংস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে।

২০১৭ সালে চীন আর্থিক ঝুঁকি কমাতে প্রবৃদ্ধির ‘উচ্চগতির’ চেয়ে উচ্চ মানকে অগ্রাধিকার দেয়। তারপর ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কমিটি নামক একটি কেন্দ্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা গঠন করা হয়। সব সংস্থাকে এই সংস্থা সমন্বয় করে থাকে। ২০১৮ সালে চীন সরকার আর্থিক খাতে বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্যোগ নেয় এবং ব্যাংক ও বিমা খাতের আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে একীভূত করে চায়না ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশন (সিবিআইআরসি) নামের আলাদা একটি কমিশন গঠন করে। এরপর কেন্দ্রীয়
ব্যাংক বিশেষ ক্ষমতায় সিবিআইআরসিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ফলে আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় গোটা আর্থিক খাত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এরপর আর্থিক খাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। তারা নন–ফাইন্যান্সিয়াল বিজনেসের ওপরও কঠোর নজরদারি শুরু করে।

২০১৭ সালে এক বক্তৃতায় জ্যাক মা বলেছিলেন, ‘আমাদের সব সময়ই নিয়ন্ত্রকদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে হবে। সেটা আমরা না পারলে দৌড়াবই না।’ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রকদের কাছে অবশেষে জ্যাক মা–ও ধরা পড়তে যাচ্ছেন

আর্থিক খাতবহির্ভূত যেসব প্রতিষ্ঠান প্রথম থেকেই সিবিআইআরসির লক্ষ্যবস্তু ছিল, সেগুলোর অন্যতম ‘অ্যান্ট’। এই গ্রুপ জন্মলগ্ন থেকে নিজেকে ইন্টারনেট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছে এবং বিশদভাবে আর্থিক সেবা দিতে তারা আলিপে (চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল পেমেন্ট অ্যাপ) ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু অ্যান্ট চীনা নিয়ন্ত্রকদের অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ, এর বেশির ভাগ পরিষেবা বিদ্যমান আর্থিক বিধির আওতার বাইরে। অধিকন্তু অ্যান্টের ক্ষিপ্রগতির প্রবৃদ্ধি এবং নতুন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বেপরোয়া সম্প্রসারণ চীনা নিয়ন্ত্রকদের উচ্চসতর্কতায় যেতে বাধ্য করেছে। পিবিওসির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রানীতি হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূলধন রিজার্ভের সামঞ্জস্য বিধান করা। তবে অ্যান্টের এই রিজার্ভ মূলধনের শর্ত পূরণ করার দরকার হয়নি। কারণ, বিদ্যমান ব্যাংকিং সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি কোনো ব্যাংক নয়। এরপর অ্যান্ট যখন চীনের স্টক এক্সচেঞ্জে আইপিওর আবেদন করে, তখন তাদের অর্থঋণ দেওয়ার ধরন ও মূলধনের বিশদ বিবরণ দেখে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সতর্ক হয়ে যায়। তাদের ধারণা হয়, অ্যান্টের শেয়ারবাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা শেয়ারবাজারে তোলপাড় সৃষ্টি করবে এবং এর শেয়ার বাবল বা বুদ্‌বুদের মতো স্ফীত হয়ে পড়তে পারে।

মাত্র ছয় মাসের ইতিহাসে অ্যান্ট যে বিশাল পরিমাণে ঋণ দিয়েছে, তা পিবিওসির জায়গা থেকে বিবেচনা করলে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এটি শেয়ারবাজারে এলে অ্যান্টের দেওয়া ঋণের একেবারে শেষ ধাপের ঋণদাতা হিসেবে এর দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিবিওসির ওপরই পড়বে। অ্যান্ট যদি কখনো দেউলিয়া হয়, তাহলে তাকে উদ্ধারে নতুন করে আরও ঋণ দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই।

এই কারণে অ্যান্টের আইপিও ছাড়া হবে কি না, তা নিয়ে নিয়ন্ত্রকেরা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু জ্যাক মার ভাষণের পর এটি স্থগিত করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। অ্যান্টের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুখে দিয়েছে দেখে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর নিতে শুরু করে দেয়। আর তাতেই চীনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধাক্কা খায়।

২০১৭ সালে এক বক্তৃতায় জ্যাক মা বলেছিলেন, ‘আমাদের সব সময়ই নিয়ন্ত্রকদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে হবে। সেটা আমরা না পারলে দৌড়াবই না।’ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রকদের কাছে অবশেষে জ্যাক মা–ও ধরা পড়তে যাচ্ছেন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

আঙ্গেলা হুইউ ঝ্যাং ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের দ্য সেন্টার ফর চায়নিজ ল-এর পরিচালক