সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রবক্তা আমেরিকা। আমেরিকার শত্রু চীন। তাই সরল হিসাবে আমেরিকার যুদ্ধ চীনের লড়ার কথা নয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান রূপকার সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড গত হলেন এই সপ্তাহে। গুরু বিদায় নিলেও তাঁর ভাষাতেই কথা বলছেন চীনের অবিসংবাদী নেতা সি চিন পিং।
পাকিস্তানেও তাড়া খাচ্ছে উইঘুরেরা
মুসলমানদের মুক্তির ভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে পাকিস্তান, উইঘুরের মুসলমানেরা সেখানে পালিয়েও টিকতে পারছে না। চীনের নির্দেশে তাদের আটক করা হচ্ছে, বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে উইঘুরদের প্রতিষ্ঠান। অনেককে আবার চীনে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ওই সব ফেরত পাঠানো ব্যক্তির আর খোঁজ মিলছে না।
পাকিস্তান অতীব চমৎকার! যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের অংশীদার ছিল, যেমন এখনো রয়েছে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদিদের যুদ্ধে। ইদানীং অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পাকিস্তান মুরব্বি বদল করে চীনের ‘জানি দোস্ত’ হয়েছে। যথারীতি উইঘুরদের বিরুদ্ধে, চীনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও শামিল পাকিস্তানি সেনাসমর্থিত ইমরান খানের সরকার। আগে টাকা দিত যুক্তরাষ্ট্র। এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) নামের মেগা প্রকল্পে ৬৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন। এটাই এখন মুষড়ে পড়া পাকিস্তানি অর্থনীতির ধমনি। টাকাই কথা বলে। তাই চীনকেন্দ্রিক এই উন্নয়নের বলি হতে হচ্ছে পাকিস্তানের উইঘুর প্রবাসীদের।
চীনের যে জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের বসবাস, তারই লাগোয়া হলো পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকা। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের সড়ক সংযোগ সাংহাই থেকে জিনজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত এলাকার ভেতর দিয়ে গিলগিট দিয়েই পাকিস্তানে প্রবেশ করে চলে গেছে বাল্টিস্তানের গদর বন্দর অবধি। এই গিলগিট-বাল্টিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার এক উত্তপ্ত ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র। এর পাশেই রয়েছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর, এর পাশেই চীন। চীন চাইছে গিলগিট এলাকায় উইঘুরদের বিতাড়ন করতে হবে, চীনের হাতে তুলে দিতে হবে। ওদিকে বালুচ স্বাধীনতাকামীরা চীনের শত্রুকে নিজেদের বন্ধু মনে করছে। তারা আশ্রয় দিচ্ছে উইঘুরদের। তখন চীন বলছে, বালুচ বিদ্রোহীরা উইঘুরদের পূর্ব তুর্কমেনিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। চীনা রাষ্ট্রদূত অল্পের জন্য বোমা হামলা থেকে বেঁচে গেছেন। চীনা প্রকল্পে বালুচ বিদ্রোহীদের হামলার বড় বড় ঘটনাও আছে।
জর্জ বুশের ভাষা সি চিন পিংয়ের মুখে
জর্জ বুশ আফগানিস্তানে গণতন্ত্র, শান্তি ও উন্নতি আনতে আগ্রাসন চালিয়েছিলেন। ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছিলেন, ইরাক আগ্রাসনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও গণতন্ত্র আসবে। কিন্তু আসেনি। চীনের মুকুটহীন সম্রাট প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও উইঘুরে উন্নতি, সুখ ও নিরাপত্তা বাড়ার দাবি করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অভিযোগমতে, চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে রি-এডুকেশন সেন্টার নামের বন্দিশালায় আটকে রেখেছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস ও আচরণ বদলে দিয়ে চীনাকরণ চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন আফগান নারীদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, চীন বলছে, তারা উইঘুর নারীদের কেবল সন্তান জন্ম দেওয়ার হাত থেকে মুক্তি দিচ্ছে। মুক্তি দিচ্ছে বন্ধ্যকরণ করে। বন্দিশালায় ধর্ষণের অভিযোগও করেছে পালিয়ে আসতে পারা উইঘুরেরা।
১৯৫৩ সালে জিনজিয়াংকে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল হান আর ৭৫ শতাংশ ছিল উইঘুর মুসলিম। কিন্তু ঔপনিবেশিক ইসরায়েলি কায়দায় উইঘুরদের ডিঙিয়ে গেছে চীনের শাসক জাতি হানেরা।
চীনা জাতীয়তাবাদ ও ভূরাজনীতির বলি
শুধু মুসলমান বলেই নয়, উইঘুরেরা উইঘুর বলেও আক্রান্ত। চীনে অনুমোদিত ৫টি ধর্মের মধ্যে ইসলামও রয়েছে। চীনের অন্য অঞ্চলের মুসলমানেরা চীনা বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাদের ইসলাম চীনা ধরনের। কিন্তু উইঘুরদের জাতিগত উৎস তুর্কি। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম তিনটিই চীনের একশিলা জাতীয়তাবাদে অগ্রহণযোগ্য।
তৃতীয় এবং আশু পারিপার্শ্বিক কারণটি অর্থনৈতিক। জিনজিয়াং বিরাট প্রদেশ হলেও জনসংখ্যা কম। তার ওপর এই অঞ্চলে রয়েছে খনিজ। সাংহাই থেকে বেল্ট অ্যান্ড রোডের সংযোগ গেছে উইঘুর শহর কাশগরে, সেখান থেকে পাকিস্তানে। মিয়ানমার যেভাবে আরাকানে চীন ও ভারতের বিনিয়োগের জন্য রোহিঙ্গাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করছে, চীনও উন্নয়নের দরকারে অগ্রহণযোগ্য জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় খাঁচায় ঢোকাচ্ছে।
আর এ কাজে তাদের কায়দাটা স্প্যানিশ রিকনকুইস্তাদোরদের মতো। আন্দালুসিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্য হটানোর পরে তারা সেখানকার ইহুদি ও মুসলমানদের বলেছিল, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম ত্যাগ করে স্প্যানিশ খ্রিষ্টান হয়ে যেতে। আরব খ্রিষ্টানদেরও স্পেনীয়করণ চলে। একই কাজ হয় সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত বলকান অঞ্চলে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত তুর্কি ভাষাভাষীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি দমন করা হয়। চীনের মডেলও সেটাই যে তোমরা চীনা হয়ে যাও।
আঞ্চলিক সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যা বানানো
চীনের দুটি কথিত স্বায়ত্তশাসিত এলাকার একটি হলো একদা উইঘুর সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনজিয়াং এলাকা, অন্যটি হলো তিব্বত। কিন্তু তিব্বতের স্বাধিকার আন্দোলনকে তারা সন্ত্রাসী না বললেও উইঘুরদের সন্ত্রাসী হুমকি বলছে। নয়-এগারোর সন্ত্রাসী হামলার পর চীন উদ্ভাবন করেছে ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) নামক হুমকি। পাকিস্তানের গণমাধ্যমেও এই ইটিআইএমকে হুমকি মনে করা হয়।
ইসলামাবাদের চীনা কূটনৈতিক মিশনের উপপ্রধান লিজিয়ান ঝাও মনে করেন, পাকিস্তানি উইঘুরেরা ইটিআইএমের অংশ। চীন তাদেরই ২০০৫ সালের উরুমকিতে বোমা হামলায় ১৪০ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে। ঝাও সম্প্রতি চীনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের পরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, উইঘুরেরা জিনজিয়াংকে চীন থেকে আলাদা করতে চায়।
উইঘুরেরা মোঙ্গল বা তিব্বতিদের মতো নিজ এলাকার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। ১৯৫৩ সালে জিনজিয়াংকে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ ছিল হান আর ৭৫ শতাংশ ছিল উইঘুর মুসলিম। কিন্তু ঔপনিবেশিক ইসরায়েলি কায়দায় উইঘুরদের ডিঙিয়ে গেছে চীনের শাসক জাতি হানেরা।
সপ্তম শতাব্দীতে চীন তার পশ্চিমের তুর্কিপ্রধান অঞ্চলকে সাম্রাজ্যের অংশ বানিয়ে নাম দেয় জিনজিয়াং। চীনা ভাষায় এর অর্থ নতুন রাজ্য বা নতুন সীমান্ত। এ থেকেই বোঝা যায়, জিনজিয়াং চিরকাল চীনের অংশ ছিল না। কিন্তু চীনা কমিউনিস্ট পার্টি চীনকে জয় করার আগে অল্প সময়ের জন্য উইঘুরেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা যেমনটা চেয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তাহলেও বর্তমানে উইঘুরকে স্বাধীন করার চিন্তা চরমপন্থী কোনো উইঘুরও করে না। তাদের চিন্তা হলো, উইঘুরদের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার এবং নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচানোর অধিকার। এ ব্যাপারে চীন এতই কঠোর যে পাকিস্তানে উইঘুর ভাষার বিদ্যালয়গুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একদিকে রাষ্ট্র–সমর্থিত ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী। আবার একই ধরনের রাষ্ট্রের ইসলামি জিহাদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মুসলমানেরা আক্রান্ত ও আক্রমণকারী: উভয়ভাবেই চিহ্নিত হতে থাকছে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নতুন ময়দান
পরিহাসের বিষয় এই যে যে যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো মুসলিম দেশকে লন্ডভন্ড করার জন্য দায়ী, তারাই এখন উইঘুরদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছে। দেশান্তর উইঘুরদের নিয়ে সিরিয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আইএসের বিশেষ বাহিনী। এদেরই আবার ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে রাশিয়ার বলকান অঞ্চলের মুসলিম সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টির কাজে। উদ্দেশ্য, রাশিয়াকে খোঁচাখুঁচি করা। তারই অংশ হিসেবেই বোধ হয়, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে বিগত ট্রাম্প প্রশাসন ইটিআইএমকে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেয়। কিন্তু আগে যে তারা তাদের সন্ত্রাসী বলেছিল, সেটাকে পুঁজি করেই চীন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। মুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের ন্যায্য দাবিকে ‘সন্ত্রাস’ বলে দেখার যে ভাষা চালু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেই ভাষাই এখন সি চিন পিংয়ের মুখে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সুবাদে চীনের সরকারি দলিলে উইঘুরেরা মুসলিম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ থেকে পরিণত হয় মুসলিম ‘ধর্মীয় চরমপন্থী’তে। সঙ্গে সঙ্গে তারা পরিণত হয় পাকিস্তানের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একটিতে।
সমস্যা ধর্ম নাকি আধিপত্যবাদ?
আলকায়েদা বলি, আইএস বলি বা বলি ইটিআইএম, আসল সমস্যা হলো ‘ইসলাম’ নিয়ে। ওয়ার অন টেররের সুবিধা অনুযায়ী মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মিত্র ‘ইসলাম’কে হুমকি হিসেবে দাগিয়ে দেয়। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব এই সমীকরণকে মানুষের চিন্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে ভালোই সক্ষম হয়। আমরা দেখতে পাই, ইসলামকে ‘হাতিয়ারকরণ’।
একদিকে রাষ্ট্র–সমর্থিত ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী। আবার একই ধরনের রাষ্ট্রের ইসলামি জিহাদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মুসলমানেরা আক্রান্ত ও আক্রমণকারী: উভয়ভাবেই চিহ্নিত হতে থাকছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়েও দেখা যায়, ফ্রান্স তার মুসলিম নাগরিকদের ফরাসি সমাজের জন্য অযোগ্য মনে করছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ধর্মবিদ্বেষী বাণী দিচ্ছেন। ভারতের বিপুলসংখ্যক মুসলমান নাগরিকত্ব সংস্কার আইনে রাষ্ট্রহারা হওয়ার হুমকিতে। সাধারণভাবে মুসলমান মাত্রই সন্দেহজনক ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে সেখানে। মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও বিতাড়ন তো এই সময়ের অন্যতম বৈশ্বিক ঘটনা। এভাবে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র বানিয়ে নিচ্ছে যার যার ‘মুসলিম সংখ্যালঘু’ সমস্যা। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠকে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে চালনা করা গেলে সংখ্যাগুরুদের দিক থেকে শাসকদের হুমকি কমে।
উইঘুর বলি বা রোহিঙ্গা বলি বা কাশ্মীর কিংবা ফিলিস্তিনি বলি বা বলি বাংলাদেশেরই কোনো নিপীড়িত জনজাতির কথা। সাম্প্রদায়িক কিংবা জাতিবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিতে যাকে মনে করা হচ্ছে নিরাপত্তার হুমকি, মানবিক দৃষ্টিতে দেখলে সেটা ধর্মীয় সমস্যাও নয়, নিরাপত্তা সমস্যাও নয়, সেটা আসলে বৃহতের ছোটকে অধিকার না দেওয়ার সমস্যা। অধিকৃত জাতি রুখে দাঁড়াবেই, কিন্তু অধিকারসম্পন্ন জাতি হতে পারে বন্ধু ও সহযোগী।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]