চির সংগ্রামীর মহাপ্রস্থান
আসমা জাহাঙ্গীরের আকস্মিক মৃত্যু আমাদের অনেককে সাংঘাতিক একটি ধাক্কা দিল। এর কারণ এই নয় যে তিনি ৬৬ বছরেই চলে গেলেন; বরং তাঁর আরও অনেক পথ যাওয়ার ছিল এবং বহু কিছু করার ছিল, সেটাই আমাদের ধাক্কা খাওয়ার মূল কারণ। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নেত্রী। তিনি নারীর অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। নিজের দেশ পাকিস্তানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর সব কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ছোটবেলা থেকেই মানবাধিকারের পক্ষে আসমা সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে জেনারেল ইয়াহিয়া জেলে পাঠানোর পর আসমার বাবা মালিক গুলাম জিলানি তীব্র প্রতিবাদ করেন। এর ফলে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। তখন আসমা একজন ছাত্রী। এই বয়সেই তিনি বাবার পক্ষে আইনি লড়াই চালান। জিয়াউল হকের সামরিক শাসনের সময় সবাই যখন টুঁ-শব্দটি করছিল না, তখন তিনিই তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলায় ১৯৮৩ সালে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের প্রতিবাদ করায় তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
মানবাধিকারের পক্ষে নিজের করা কাজগুলোকে আসমা একরকম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গেছেন। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারপারসন এবং সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে তিনি কোর্টে মামলা লড়তেন, বিভিন্ন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রচারণায় যোগ দিতেন। জাতিসংঘের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার হিসেবে তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক একই পদে ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকার উন্নয়নের লক্ষ্যে সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর) গঠনের সময় একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে আসমাকে ঘনিষ্ঠভাবে আমার চেনার সুযোগ হয়। এই সংগঠনের প্রথম কো-চেয়ারম্যান হিসেবে আসমা মানবাধিকারবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই নয়, বরং এই অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলেছিলেন। তাঁর জোরালো নেতৃত্বের কারণেই এসএএইচআরের পক্ষে সাধারণ নির্যাতন ও কারা হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনার প্রামাণ্য দলিল তৈরি করা সম্ভব হয়।
নারী অধিকারের নেত্রী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের বিতর্কিত হাদুদ অর্ডিন্যান্সকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং বিভিন্ন ফোরামে নারীর স্বাধীনতা নিয়ে জোরালো বক্তৃতা করেন। আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানে আসমা জাহাঙ্গীরের অনেক বড় জয় আছে। ‘মালিকদের’ কাছ থেকে শ্রম দাসদের মুক্ত করার ঐতিহাসিক মামলা থেকে শুরু করে নারীকে তাঁর নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করতে দেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার মামলায় তাঁর জয় মাইলফলক হয়ে আছে।
একবার ঢাকা সফরের সময় তিনি মানবাধিকারকর্মীদের একটি সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করলেও তাঁর প্রভাব এই অঞ্চলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চিয়াং মাই-ভিত্তিক এশিয়া প্যাসিফিক উইমেন অ্যান্ড ল নেটওয়ার্কের একজন সদস্য হিসেবে তিনি পুরো এশিয়ার নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমাদের উজ্জীবিত করেছেন।
মৃত্যুকালে আসমা জাতিসংঘের ইরানের মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও ইরানে ঢোকার অনুমতি পাননি, তথাপি তিনি বিকল্প উপায়ে দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করেছেন এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দাখিল করার জন্য সেগুলো তিনি নথিবদ্ধ করেন। নিজ দেশের আদালত ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার ভূমিকা রাখার জন্য আমরা আসমাকে মনে রাখব। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে সুইডেনের রাইট টু লাইভলি অ্যাওয়ার্ড এবং একই বছরে ফ্রান্সের অফিসার ডি লা লেজিওন ডি’ওনিয়র পুরস্কারসহ সারা জীবনে তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে প্রবল সাহস প্রদর্শনের জন্য আসমাকে আমরা শ্রদ্ধা করে যাব। লোভ আর ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্মিলিত সংগ্রাম জারি রাখাই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
হামিদা হোসেন মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য