চট্টগ্রামের জন্য টেকসই নগর-পরিকল্পনা

অপরকিল্পত নগরায়ণের ফলে চট্টগ্রামে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ছবি প্রথম আলো

বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের স্বল্পতম নগরায়িত দেশগুলোর অন্যতম। এমনকি এই একুশ শতাব্দীর সূচনায় ২০০১ সালেও জাতীয় জনসংখ্যার মাত্র ২৩ শতাংশ নগর ও শহরগুলোয় বাস করছিল। তবে আমাদের জনসংখ্যার বিশাল আকৃতির কারণে ২৩ শতাংশের অর্থ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ। বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি হারে নগরায়ণ হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে নগরের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম দুই হাজার বছরের একটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ শহর, যার নামের পেছনে গ্রাম শব্দটি থাকলেও আসলে এটি কোনো গ্রাম নয়। এর সংস্কৃতিও গ্রাম্য নয়। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে চট্টগ্রাম একটি কসমোপলিটন নগর। এখানে আরব, ইংরেজ, মগ, পর্তুগিজরা এসেছিল। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য, কেউ ধর্ম প্রচার, কেউ শাসন ও শোষণ করার মানসে। আবার কেউ এসেছিল দস্যুতা ও লুণ্ঠনের জন্য।

বিচিত্র মানুষের উপস্থিতি ও অপরূপ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে গড়ে ওঠে মিশ্র সংস্কৃতি ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য, যার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলার মিল নেই। বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামেরও উন্নয়ন হয়েছে। তবে কায়েমি স্বার্থবাদীরা চট্টগ্রামকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে উঠতে দেয়নি। চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের সঠিক পরিকল্পনা করা হয়নি। তাই বিশৃঙ্খলভাবে চট্টগ্রাম শহর আকারে বড় হয়েছে। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ হারিয়ে হয়েছে রুগ্ণ।

শুধু মহাপরিকল্পনা করলেই চলবে না, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এর আগের মহাপরিকল্পনাগুলো কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তারও মূল্যায়ন করা দরকার। নইলে একই ব্যর্থতার পূর্ণরাবৃত্তি চলতেই থাকবে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ সমস্যার সমাধান হবে না।

৬০ থেকে ৭০ বছর আগে খাল ও নদীর মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের বৃষ্টির পানি সহজেই নিষ্কাশন হতো। প্রাচীনকাল থেকে বাণিজ্যতরিগুলো শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যেত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চকবাজার ছিল চট্টগ্রামের অন্যতম বাজার। মালামাল নিয়ে নৌকাগুলো খাল বেয়ে সেখানে পৌঁছে যেত।

কিন্তু নগরটি অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠার ফলে আজ জলাবদ্ধতা খাতুনগঞ্জ, চাকতাইয়ের মতো বাণিজ্যকেন্দ্রের প্রকট সমস্যা সৃষ্টি করছে। শুধু তা-ই নয়, আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকলিয়া, মোহরাসহ নিম্নাঞ্চলের আবাসিক এলাকায় বর্ষার মৌসুম ছাড়া ও জোয়ারের পানিতে সয়লাব। সেখানে তখন নৌকায় জনগণ যাতায়াত করে।

চট্টগ্রামে যে কয়টা পাহাড় এখনো ন্যাড়া হয়ে বেঁচে আছে, সেগুলোর সৌন্দর্যের চেয়ে ধ্বংসের আতঙ্ক হয়ে বেশি মূর্তমান। বর্ষা এলেই লোকজন সরানোর জন্য তৎপর হয় প্রশাসন।
অবশেষে চট্টগ্রাম আধুনিক নগরের জন্য ২১ বছরের নতুন মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় পুরো নগরীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশদ সমীক্ষা হবে। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে অনুযায়ী তৈরি হবে ২০২০ থেকে ২০৪১ সালের ২১ বছরের নতুন মহাপরিকল্পনা।

এটি সিডিএর তৃতীয় মহাপরিকল্পনা। এর আগে ‘প্রিপারেশন অব স্ট্রাকচার মাস্টারপ্ল্যান অ্যান্ড ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান ১৯৯৫’ নামে চট্টগ্রাম শহরের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সিডিএ। কিন্তু কখনো কোনো মহাপরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।

নতুন মহাপরিকল্পনার প্রকল্পসূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, এবারের মহাপরিকল্পনার সমীক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল (ইউএভি), লাইডার (সর্বাধুনিক ড্রোন), টেরেস্টারিয়াল লেজার স্ক্যানার (টিএলএস), স্টিরিও স্যাটেলাইট ইমেজসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি।

মহাপরিকল্পনা প্যাকেজে মোট ছয়টি অংশ থাকবে। এই পরিকল্পনায় রাখা হবে বন্যা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ সিস্টেম। থাকবে দীর্ঘমেয়াদি ট্রাফিক ও যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা। বৈশ্বিক জলবায়ু বিবেচনা করে শহরকে দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ রাখতে থাকবে টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। এ ছাড়া থাকবে কাঠামো পরিকল্পনা, অ্যাকশন এরিয়া প্ল্যান এবং সঙ্গে যুক্ত থাকবে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় সাধনের নির্দেশনামূলক পরিকল্পনা।

মোদ্দাকথা, বাসযোগ্য চট্টগ্রাম গড়তে দরকার টেকসই ও বাস্তবসম্মত নগর-পরিকল্পনা। কারণ, ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে, মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় চট্টগ্রাম শহর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। যে যেভাবে পারছে, নিজেদের মতো উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে সব সেবা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

তাই চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল দেশের অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখছে, তাতে অতি দ্রুত বাসযোগ্য ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু শুধু মহাপরিকল্পনা করলেই চলবে না, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এর আগের মহাপরিকল্পনাগুলো কেন বাস্তবায়িত হয়নি, তারও মূল্যায়ন করা দরকার। নইলে একই ব্যর্থতার পূর্ণরাবৃত্তি চলতেই থাকবে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ সমস্যার সমাধান হবে না। ফলে এই নগরের বাসযোগ্যতা দিনে দিনে আরও কমে যাবে।

মো. শাহ জালাল মিশুক চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
Email: [email protected]