গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন কীভাবে সম্ভব

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসের অভাব থাকায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। এ ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের কীভাবে বাছাই করা হয়েছিল, সে ধারণা আমার কখনো ছিল না। আমার ধারণা, দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের জন্যই তা কোনোভাবেই স্বচ্ছ ছিল না। এর ফলে ভোটযুদ্ধে বিজিত দলের ভোটে পক্ষপাতিত্ব হয়েছে, এ কথা বলার সুযোগ ছিল এবং সেটি তারা করেছেও। রাজনীতির বিজ্ঞানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে, যদিও আমাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে আর কোনো দেশ কিংবা জাতি অনুরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে কি না কিংবা চিন্তা করেছে কি না জানা নেই। তবে গণতন্ত্রের অনুশীলনী ও বিকাশে যে পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজন হয়, যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের প্রয়োজন হয় এবং জাতীয় অগ্রগতিতে যে ন্যূনতম সমঝোতার প্রয়োজন হয়, তার অভাব দেখা দিলে ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়ায় সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি পরিবেশ প্রয়োজন, যাতে জনমত যাচাই সম্পর্কে সাধারণ্যের মধ্যে কোনো ধরনের সন্দেহ না থাকে।

আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সূচনা করেছিলাম এবং তার ছেদও ঘটিয়েছি। কিন্তু আমরা সবাই কি মনে করি, যে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম, সে সমস্যা আর নেই? পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী দলও শাসনকে চিরস্থায়ী করতে পারেনি, সমস্যাবিক্ষুব্ধ বাংলাদেশে যে তা অধিকতর সত্য, তা স্বাধীনতার পর শাসনকালের ঘনঘন পালাবদলই তার প্রমাণ। যুগে যুগে প্রায় চিহ্নহীন, ক্ষমতাহীন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সরকারি দলের যে জয়জয়কার, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, তারপরও ক্ষমতাসীন দল চিরদিনের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারে না, একসময় তাদের বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। সেই দুর্ভাগ্য আমাদের উভয় বৃহৎ দলেরই হয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষা—সব দেশেই এ রকম পালাবদল হয় এবং আমরাও এর ঊর্ধ্বে থাকব না।

নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের জন্য যতই অনুসন্ধান কমিটি করা হোক না কেন, শেষাবধি ওই পদগুলোয় প্রার্থী বাছাইয়ে সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণের ভারসাম্য নিশ্চিত না হলে নির্বাচন কমিশনের ওপর উভয় দলের আস্থার ভারসাম্য তৈরি হবে না। সরকারি দল যেমন চাইবে নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা তাদের পক্ষে কাজ করবেন, যদিও তাঁরা রীতিমতো শপথ করে ওই পদে যাবেন যে তাঁরা কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব করবেন না, বিরাগের বশবর্তী হয়েও কাজ করবেন না। একইভাবে বিরোধী দলও চাইবে এমন কর্তাব্যক্তিরাই নির্বাচন কমিশনে স্থলাভিষিক্ত হোন, নিরপেক্ষ থাকতে না পারলেও যাঁরা তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারবেন। শাসন করতে করতে মহাগণতান্ত্রিক দলও স্বৈরাচারের চরিত্র ধারণ করে। তবে নেলসন ম্যান্ডেলারা কিন্তু ক্ষমতার বলয়ের বাইরে চলে গেলেও জনপ্রিয়তার স্রোতে হারিয়ে যান না, স্বেচ্ছায় ক্ষমতাহীন হলেও তাদের দেশত্যাগ করতে হয় না। আমরাও অপেক্ষা করছি সেই সুদিনের, যখন আমাদের ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও ক্ষমতা হারানোর পরও দেশে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে তাদের জীবন পরিচালনা করতে পারবে। শুধু তা–ই নয়, নতুন ক্ষমতাসীন দলও দেশ পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগাবে।

এযাবৎকালে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসগুলোর গঠনপদ্ধতির গণতান্ত্রিক দিকটি আমি বুঝতে পারিনি। অনেককে জিজ্ঞাসা করেও এর গঠনপদ্ধতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারিনি। বুঝতে পারি, আমি আদার ব্যাপারী জাহাজ সম্পর্কে জানা অনধিকারচর্চামাত্র। তবু তো গণতন্ত্র বলে কথা! কোনো না কোনোভাবে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা থাকা প্রয়োজন। তা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া যদি আমাদের কাছে কালো বাক্সের মতো হয়, তাহলে তার প্রতি বিশ্বাস কীভাবে স্থাপন করব?

এযাবৎকালে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসগুলোর গঠনপদ্ধতির গণতান্ত্রিক দিকটি আমি বুঝতে পারিনি। অনেককে জিজ্ঞাসা করেও এর গঠনপদ্ধতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারিনি। বুঝতে পারি, আমি আদার ব্যাপারী জাহাজ সম্পর্কে জানা অনধিকারচর্চামাত্র। তবু তো গণতন্ত্র বলে কথা! কোনো না কোনোভাবে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা থাকা প্রয়োজন। তা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়া যদি আমাদের কাছে কালো বাক্সের মতো হয়, তাহলে তার প্রতি বিশ্বাস কীভাবে স্থাপন করব?

অনুসন্ধান কমিটি তৈরি হয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকেরা পরামর্শ দিয়েছেন, এর মধ্যে প্রস্তাবিত নামগুলোও প্রকাশ করা হয়েছে, এখন নির্বাচন কমিশনের সম্ভাব্য সদস্যদের তালিকা তৈরি হবে। সেখান থেকে যাচাই–বাছাই করে নিশ্চয়ই অনুসন্ধান কমিটি হয়তো ১০টি নাম প্রস্তাব করবে, যা থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো তালিকাভুক্ত করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে, সেসব নামে যে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা থাকবে, তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারবে? নিশ্চয়ই না। নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের বিরুদ্ধে গেলে তারা শত কণ্ঠে বলার সুযোগ পাবে যে কমিশনটি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল।

আরও পড়ুন

রাজনীতিবিজ্ঞান আমার পড়ার বিষয় নয় এবং অনেক কিছুই বোধের অগম্য। তবে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে র‍্যাঙ্কিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে থাকি, সেটা দাবা খেলা, ফুটবল কিংবা পণ্য বাছাই অথবা গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে কিছু ব্যক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। হয়তো ওই কঠিন অ্যালগরিদম আমরা এখানে ব্যবহার করতে পারব না। তবে এই বাছাইপদ্ধতিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলেও তাদের একধরনের আত্মসন্তুষ্টি তৈরি হতে পারত। আমি পত্রপত্রিকায় একাধিকবার এ বিষয়ে লিখেছি। বিজ্ঞজনেরা এগুলো নিয়ে কখনো আলাপ করেছেন বলে মনে হয়নি। এর থেকে বোঝা যায়, আমার প্রস্তাবটি আলোচনার যোগ্যই নয়। তাও আবার তা তুলে ধরছি, যার মাধ্যমে আমার আনাড়িপনার আবার প্রকাশ ঘটবে।

আমরা এমন একটি নির্বাচন কমিশন চাই যেন কোনো দলই (সুবিধার্থে ধরে নিচ্ছি শাসক দল ও বিরোধী দল) নির্বাচন কমিশনকে বিরোধী শক্তি বলতে না পারে। এটা করতে হলে তাদের উভয় দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অর্থাৎ তাঁরাই নির্বাচন কমিশনের সদস্য হবেন, যাঁরা উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের সদস্য হওয়ার যে প্রাক্‌–যোগ্যতা, সেটাও যাতে উভয় দলের আগে থেকেই জানা থাকে। অনুসন্ধান কমিটি আয়োজিত একটি টেলিভিশন প্রোগ্রামে গ্রহণযোগ্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দল উপস্থিত হবে। যতক্ষণ উভয় দলের তালিকা থেকে পর্যাপ্তসংখ্যক অভিন্ন নাম পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ তাদের নামের তালিকা প্রলম্বিত করতে হবে। সারা দেশের মানুষ এ ধরনের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের কাজ প্রত্যক্ষ করতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পরিচালনায় সেই তালিকাগুলো থেকে প্রথমে ১০টি (অন্যসংখ্যকও হতে পারে) নামের মধ্যে প্রথম মিল খুঁজতে হবে। মিল হলে একজনের নাম পেয়ে গেলাম, যা উভয় তালিকাতেই আছে (আমাদের শঙ্কা, এ রকম নাম খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে)। এখানে শর্ত থাকবে, উভয় দলকে পর্যাপ্তসংখ্যক নামে সম্মত হতে হবে। তাই আশা করা যায়, তালিকাগুলো খুব এককেন্দ্রিক হবে না। মিল না হলে প্রথম ২০, প্রথম ৪০, এভাবে যেতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যাপ্তসংখ্যক নাম না পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

সারা দেশের মানুষ জানতে পারবে যে উভয় দলের সম্মতিতেই সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনারদের তালিকা তৈরি হয়েছে এবং তাদের পক্ষপাতিত্বের দোষারোপ করা আর দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ধরনের একটি কমিশন যে কোনো দলের অন্ধ সমর্থক হবে না, তা বলাই বাহুল্য। পরিশেষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সে তালিকা থেকে কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। এরপরও এখানে সরকারি দল কিছুটা সুবিধা পেতে পারে, প্রেসিডেন্ট যখন দলীয় ব্যক্তি কেউ হন, সেই সম্ভাবনা থেকেই যায়।
সরকারি ও বিরোধী দলের এ রকম স্বচ্ছ অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে অন্য কোনো পদ্ধতিই উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, বিশেষ করে নির্বাচনে হারার পর। প্রস্তাবটি খুবই সহজ করে উপস্থাপন করা হলো। তবে এ ব্যবস্থায় নানা প্যারামিটার সংযোজন করে একে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করা যেতে পারে। আমি আশা করি, নির্বাচনের বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে দেখবেন। সংবিধান মেনেই সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বলে আশা রাখি।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো