সম্প্রতি দেশীয় গ্যাস কোম্পানিগুলো গ্যাসের মূল্যের আকাশচুম্বী বৃদ্ধির যে প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে, তা সব মহলকেই হতবাক করেছে। এ প্রস্তাবে প্রতি ক্ষেত্রেই গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ বা তার বেশি করার সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন একজন এক বার্নার চুলার জন্য প্রতি মাসে ৯২৫ টাকার পরিবর্তে দেবেন ২ হাজার টাকা, পরিবহনে সিএনজির মূল্য ইউনিটপ্রতি ৩৫ টাকার পরিবর্তে হবে ৭৬ টাকা, শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের মূল্য ১০ টাকার পরিবর্তে ২৩ টাকা। এটি বাস্তবায়িত হলে জনসাধারণের খাদ্য, পরিবহনসহ সব খরচের ঊর্ধ্বমুখী চাপ যে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে, তা কেন প্রস্তাবকারী ব্যক্তিদের বিবেচনায় এল না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ বটে।
উচ্চ মূল্যের গ্যাস (এলএনজি) আমদানির আর্থিক চাপ সামলাতে দেশে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হবে, এটি অনেকেরই আশঙ্কা ছিল। আমদানি করা এলএনজি দেশে উৎপাদিত গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে যে মিশ্রিত গ্যাস বর্তমানে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়, তার মূল্য প্রথমবার সমন্বয় করা হয় ২০১৯ সালে। মূল্য সমন্বয়ের সূত্র হলো দেশীয় গ্যাস এবং এলএনজি গ্যাসের পরিমাণের অনুপাত অনুযায়ী গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা। বাংলাদেশ ২০২১ অর্থবছরে গড়ে প্রতিদিন ৫৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি গ্যাস আমদানি করে এবং তা দেশীয় দৈনিক উৎপাদিত ২৬০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে সরবরাহ হয়।
গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের পক্ষে একটি যুক্তি দেখানো হয়েছে। তা হলো সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে তথা স্পট মার্কেটে গ্যাসের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এলএনজির স্পট মূল্য প্রকৃতই অস্থির এবং তা নানা কারণে অতি বৃদ্ধি বা হ্রাস হয়ে থাকে। গত বছরের প্রথম দিকে স্পট মার্কেটে এলএনজি মূল্য যেখানে ইউনিটপ্রতি ৫ বা ৬ ডলার ছিল, বছর শেষে তা ইউনিটপ্রতি ৪০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ গত বছর কোনো এক সময় স্পট মার্কেট থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ ডলারে এলএনজি কেনে এবং একসময় অতি উচ্চমূল্যের কারণে সাময়িকভাবে কেনা বন্ধ রাখে।
দেশে বর্তমানে মোট যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার ৭৮ শতাংশ আসে দেশীয় উৎস থেকে এবং ২২ শতাংশ আসে আমদানি করা এলএনজির মাধ্যমে। আর এই ২২ শতাংশের মধ্যে ১৭ শতাংশ আসে কাতার ও ওমান দেশ দুটির সঙ্গে সম্পাদিত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে, যাতে মূলত একটি স্থির মূল্য ইউনিটপ্রতি ১১ ডলারে এলএনজি কেনা হয়। বাকি ৫ শতাংশ এলএনজি কেনা হয় স্পট মার্কেট থেকে, যেটির মূল্যে আকাশচুম্বী উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। এই ৫ শতাংশ এলএনজি অতি উচ্চ মূল্যে কেনার জন্য সামগ্রিকভাবে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ করার প্রস্তাব নেহাত অগ্রহণযোগ্য।
বাংলাদেশ এর আগে নিজস্ব গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ক্রমাগতভাবে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। কিন্তু এলএনজি আমদানির খরচ জোগাতে ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলাকে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ জন্য বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন।
প্রকৃতপক্ষে দেশের গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য জরুরি পদক্ষেপ না নিয়েই এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভর করার পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত অপরিপক্ব ও অদূরদর্শী। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের দুর্বল ধারা বাংলাদেশকে এলএনজি ফাঁদে ফেলেছে। ২০১৪ সালে সমুদ্র বিজয়ের পর পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার তার সমুদ্র অংশে বিরাট গ্যাসের ভান্ডার আবিষ্কার করে চলেছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় কেবলই কর্মহীন স্থবিরতা কেন?
বর্তমানে এলএনজি আমদানি দেশের গ্যাস খাতে যে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে, তা লাঘবে বাস্তবধর্মী পথ কী হতে পারে? একটি মোক্ষম উপায় হলো ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত অথচ এখনো উত্তোলন করা হয়নি বা কোনো কারণে উত্তোলন স্থগিত রয়েছে, সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা।
বর্তমান অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারি, উচ্চ মূল্যের এলএনজির ব্যাপক আমদানি ভবিষ্যতে আমাদের আর্থিক সংকটে ফেলবে। অথচ দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এলএনজিনির্ভরতাই প্রাধান্য পেয়েছে। বর্তমানের জোরালো গ্যাস অনুসন্ধান ভবিষ্যতে যে এলএনজির চাপ থেকে স্বস্তি দেবে, সেটি কি বোঝা কঠিন? এটি ঠিক যে সমুদ্রের বা ভূখণ্ডের নতুন গ্যাস আবিষ্কার করে তা উঠিয়ে আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমস্যা সমাধানের বাস্তবধর্মী সমাধান কেবল এলএনজি আমদানি বলে অনেকে মনে করেন।
বর্তমানে এলএনজি আমদানি দেশের গ্যাস খাতে যে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে, তা লাঘবে বাস্তবধর্মী পথ কী হতে পারে? একটি মোক্ষম উপায় হলো ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত অথচ এখনো উত্তোলন করা হয়নি বা কোনো কারণে উত্তোলন স্থগিত রয়েছে, সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা। উদাহরণস্বরূপ ভোলা দ্বীপে ২০১৮ সালে আবিষ্কৃত ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রটি অটুট পড়ে রয়েছে। ভোলার অপর গ্যাসক্ষেত্র শাহবাজপুরে সক্ষমতার অর্ধেক গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এ দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে পুরোদমে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করার সমস্যা হলো ভোলা দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে সংযোগ পাইপ তৈরি করা হয়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার যে বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় গ্যাস কবে সরবরাহ করা যাবে বা অদৌ কোনো দিন করা যাবে কি না, সে বিবেচনা না করেই পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। কিন্তু গ্যাস পাইপলাইনের অভাবে গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না, তা কোনো জরুরি কর্মপরিকল্পনায় আসে না। একইভাবে ২০২০ সালে আবিষ্কৃত সিলেটের জকিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহের জন্য জরুরি কোনো ব্যবস্থার কথা জানা যায় না।
ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বড় আকারের প্রমাণিত মজুত থেকে মাত্র সামান্য গ্যাস তোলা হয়েছে। পাশে আরেকটি কূপ ২০০৩ সালে খনন করতে গিয়ে নাইকো রিসোর্স নামক কোম্পানি সেখানে দুর্ঘটনা ঘটায়। এ ফলে কূপটি নষ্ট হয় ও গ্যাস উত্তোলন স্থগিত হয়। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলায় জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ও নাইকো। বিস্ময়কর ব্যাপার যে নাইকোকে আদালতে নিয়ে গিয়ে আজ প্রায় ১৯ বছর ধরে আইনের লড়াইয়ে আটকে আছে সম্ভাবনাময় এই ক্ষেত্রটির গ্যাস উত্তোলন। কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে গ্যাসের এই চরম দুঃসময়ে একটি কোম্পানি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে জিম্মি করে রাখবে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থিত ভূতাত্ত্বিক কাঠামোতে ১৯৫৩ সালে গ্যাস পাওয়ার পরও সে সময় তুলনামূলক দুর্বল কারিগরি ব্যবস্থাপনায় গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়নি। বর্তমানে উন্নত কারিগরি ব্যবস্থাপনায় সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব।
এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দ্রুত ও জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে যে পরিমাণ গ্যাস এখনই সরবরাহের আওতায় আনা সম্ভব, তা দিয়ে এলএনজি আমদানির একটি বড় অংশ কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সনাতনী আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি পরিহার করে ঝটিকা ব্যবস্থাপনা গ্রহণের সদিচ্ছা ও সাহসিকতা। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান যে বর্তমান প্রশাসন দুটি ক্ষেত্রেই ‘অভাবের দোষে দুষ্ট’।
● ড. বদরূল ইমাম সাবেক অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়