গাম্বিয়ার মামলাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ
আবু বাকার তাম্বাদুর জীবনে তিনটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি আইন বিষয়ে আগাগোড়া পড়াশোনা করেছেন ইংল্যান্ডের নামী সব প্রতিষ্ঠানে। এরপর রুয়ান্ডায় গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে কাজ করেছেন প্রায় এক যুগ। গত বছর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে এসে শুনে যান একই ধরনের বর্বরতার বহু হৃদয়বিদারক কাহিনি। তত দিনে তিনি গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বও পেয়েছেন।
এটি তাই বিস্ময়কর নয় যে ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার মামলা দায়েরের ঐতিহাসিক ঘটনায় তিনিই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই মামলা দায়ের করার বিষয়টিই বিস্ময়কর এবং গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আরও দুটি মামলার প্রক্রিয়া চলছে। প্রথমটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে, দ্বিতীয়টি আর্জেন্টিনার একটি স্থানীয় আদালতে। প্রথম মামলাটির মাত্র পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চলছে। এটি বিচারিক আদালতে এলে মিয়ানমারের গণহত্যার নায়কেরা ব্যক্তিগত শাস্তি লাভ করতে পারেন। দ্বিতীয় মামলাটিতে পক্ষ করা হয়েছে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকেও।
এসব মামলার মধ্যে গাম্বিয়ার মামলাটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণে। এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আদালতটিতে এবং এই মামলায় মিয়ানমারের বিচারের জন্য সবচেয়ে শক্ত আইনগত ভিত্তি রয়েছে। এই মামলার ওপর তাই গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে বাংলাদেশকে।
২.
গাম্বিয়া মূল আফ্রিকার ক্ষুদ্রতম দেশ, মাত্র লাখ বিশেক লোক, হতদরিদ্র আর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অনুল্লেখ্য। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) একমাত্র গণহত্যা কনভেনশন অনুসারেই যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার সুযোগ রয়েছে, তা বহু দেশের জানার কথা। কিন্তু কোনো ‘মানবাধিকার গুরু’ রাষ্ট্র না, সুযোগটি গ্রহণ করেছে শুধু গাম্বিয়া।
গণহত্যা কনভেনশন বা চুক্তিটি গ্রহণ করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই। এই যুদ্ধকালে, বিশেষ করে জার্মান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এতই ভয়াবহ, নির্বিচার ও ব্যাপক ছিল যে যুদ্ধের পর গণহত্যা বন্ধের তাগিদ হয়ে ওঠে সর্বজনীন। ১৯৪৭ সালে সাধারণ পরিষদ গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৪৮ সালে এরই উদ্যোগে গণহত্যা নিবারণ এবং এর জন্য রাষ্ট্রের দায় নির্ধারণ করে গণহত্যা কনভেনশনটি গৃহীত হয়। এতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ওপর তার ভূখণ্ডে সংগঠিত গণহত্যার বিচার করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
গণহত্যা কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদে রয়েছে এই কনভেনশনের কোনো রকম লঙ্ঘন হলে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য যেকোনো রাষ্ট্র আইসিজেতে মামলা করতে পারবে। ১৯৪৯ সালে কনভেনশনটির পক্ষরাষ্ট্র হওয়ার সময় মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) অন্য দুটি অনুচ্ছেদের বিষয়ে তার আপত্তি (রিজার্ভেশন) জানালেও ৯ অনুচ্ছেদে কোনো আপত্তি জানায়নি।
৯ অনুচ্ছেদে আপত্তি বা নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করেছিল ১৬টি রাষ্ট্র, যার মধ্যে ১১টিই পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়। আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি এই অবশিষ্ট ৫টি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে পক্ষ হওয়ার সময় বাংলাদেশ ঘোষণা দেয় যেকোনো বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরোধের সব পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হবে। গাম্বিয়া ১৯৭৮ সালে কনভেনশনটির পক্ষ হয় বিনা আপত্তি বা ঘোষণায়। ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলাটি করতে কোনো সমস্যা হয়নি তার।
মামলাটিতে দায়ের করা অভিযোগপত্রে ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও তাদের পরিকল্পিতভাবে উৎখাত করার দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ মামলায় কেন ও কীভাবে গাম্বিয়া পক্ষ হয়েছে, তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। অভিযোগপত্রের শেষ দিকে গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি এবং ভিকটিমদের জন্য ক্ষতিপূরণের আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক আচরণগুলো জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করার নির্দেশ চাওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে এই মামলার শুনানি শুরু হবে।
৩.
আইসিজেতে দায়ের করা এই মামলায় মিয়ানমারের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে নানা কারণে। প্রথমত, গণহত্যার অভিযোগের যথেষ্ট প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন তথ্যানুন্ধানী কমিশন, এর মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে।
দ্বিতীয়ত, প্রায় তিন বছর আগে গণহত্যার ঘটনাটি ঘটলেও মিয়ানমার এর বিচারের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। গণহত্যা আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে এর বিচার রাষ্ট্র নিজে না করলে আন্তর্জাতিক আদালত এমনকি অন্য যেকোনো দেশের আদালত তা করতে পারেন। ফলে আইসিজের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে সফল হওয়ার সুযোগ মিয়ানমারের নেই।
তৃতীয়ত, মামলাটি ৫৬ সদস্যবিশিষ্ট ওআইসির পক্ষ থেকে দায়ের করেছে বলে এর অর্থায়নে এবং সমর্থনে কোনো সমস্যা হবে না গাম্বিয়ার। তা ছাড়া ইতিমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১০টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এ উদ্যোগের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার ঘোষণা দিয়েছে। এর সঙ্গে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট আছেন ফিলিপ স্যান্ডসসহ আরও কিছু প্রখ্যাত আইনজীবী।
আইসিজে মাত্র ২০০৭ সালে গণহত্যা–সম্পর্কিত একটি মামলা নিষ্পত্তি করেছে। ১৯৯৯ সালে দায়ের করা মামলাটিতে আইসিজি প্রথমে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে গণহত্যা বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দেয়। ২০০৭ বিচার শেষে গণহত্যা নিবারণে ব্যর্থতার জন্য এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশগুলো না মানার জন্য সার্বিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে। আইসিজে গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ইয়োগোস্লাভিয়ার কাছে সোপর্দ করার আদেশও দেয়।
আইসিজেতে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় উপরিউক্ত মামলাটিতে প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ড ও নীতিগুলো বিবেচনায় আসবে। মামলার বিচারে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
৪.
আইসিজে কাজ করে মূলত রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব নিয়ে। গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব নিরূপণের জন্য রোম স্ট্যাটিউটের মাধ্যমে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। জাতিসংঘ ও এই আদালতের বিভিন্ন অনুসন্ধানে মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তি হিসেবে ইতিমধ্যে অন্তত ছয়জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা চিহ্নিত হয়েছেন। কিন্তু গণহত্যার জন্য এঁদের বিচার করা সম্ভব হয়নি দুটো কারণে। এক. মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিউটের সদস্য বা পক্ষরাষ্ট্র নয়। দুই. সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রের ব্যক্তিদের বিচারের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের প্রয়োজন হয়, মিয়ানমারের পক্ষে চীনের অবস্থানের কারণে সেখানে এমন প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
গণহত্যা নয়, আইসিসি তাই বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে ‘জোরপূর্বক বিতাড়ন’ নামক মানবতাবিরোধী অপরাধের। এর প্রসিকিউটরের যুক্তি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ‘জোরপূর্বক বিতাড়ন’ নামক অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের মাটি পর্যন্ত। যেহেতু বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিউট পক্ষরাষ্ট্র, তাই বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধ হিসেবে এর বিচারের এখতিয়ার রয়েছে আইসিসির। এ বিবেচনার ওপর নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বিতাড়ন নামক অপরাধের ওপর পূর্ণ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইসিসি ১৪ নভেম্বর। অপরাধ হিসেবে এটি গণহত্যার চেয়ে কিছুটা লঘু এবং এর বিচারের সম্ভাবনা নির্ভর করছে তদন্তের সাফল্যের ওপর।
মিয়ানমারের ঘটনায় ১৩ নভেম্বর আরেকটি মামলা করা হয়েছে আর্জেন্টিনার একটি আদালতে। বিভিন্ন মানবাধিকার গ্রুপ ও রোহিঙ্গা সংগঠন কর্তৃক দায়ের করা এ মামলায় ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সঙ্গে অং সান সু চিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই মামলায় সু চির এক্সট্রাডিশন (প্রত্যর্পণ) চাওয়া হলে তাঁর আন্তর্জাতিক গতিবিধি সীমিত হয়ে যাবে। এশিয়ার ম্যান্ডেলা থেকে তিনি পরিণত হতে পারেন আন্তর্জাতিক ফেরারিতে।
৫.
এসব মামলা নিঃসন্দেহে বিরাট কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে মিয়ানমারের শাসক ও সামরিক বাহিনীর ওপর। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তিতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ সময়ে মিয়ানমারে প্রায় বন্দিদশায় থাকা ৪ লাখ এবং বাংলাদেশে বিতাড়িত ১০ লাখ রোহিঙ্গার মানবাধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তোলার মধ্যেই এ সংকটের প্রকৃত সমাধান নিহিত। দায়ের করা মামলাগুলো সুযোগ করে দিয়েছে এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বেগবান করার।
বাংলাদেশকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক