গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসেবে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রেখেছে। সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র সম্প্রসারণে দেশটি কাজ করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশটি বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। আজ সেই দেশের ঘরের মধ্যে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার লড়াই শুরু হয়েছে।
আমেরিকার গণতন্ত্রের ভিত্তি অবশ্য বরাবরই ত্রুটিপূর্ণ। গণতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার সময় যে ত্রুটি ছিল, তা হলো ওই সময় শুধু জায়গাজমির মালিকানা আছে—এমন শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরাই ভোট দেওয়ার যোগ্য ছিলেন।
ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির পর প্রায় এক শতাব্দীকাল ধরে দক্ষিণাঞ্চলের শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা ভোটদানের জন্য বাড়তি কর আরোপ এবং সাক্ষরতার পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছিলেন, যাতে দরিদ্র ও নিরক্ষর নাগরিকেরা ভোট দিতে না পারেন। আফ্রিকান-আমেরিকানদের বেশির ভাগ লোক তখন দরিদ্র ও নিরক্ষর ছিলেন। শুধু তাঁদের ভোট থেকে দূরে রাখতে এমন আইন করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠারও প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এই আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
এখনো বিশ্বে গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। এর কারণ হলো এই ব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করার উপায় কম থাকে। সেখানে সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা প্রাধান্য পায়। কিন্তু আমেরিকায় এখনো উল্টো চিত্র রয়ে গেছে। এখানে সংখ্যালঘুরা এখনো সংখ্যাগুরুদের ওপর বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।
এ সমস্যার পেছনে যত কারণ আছে, তার একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের খোদ সংবিধানেই নিহিত রয়েছে। এই শতকে এ পর্যন্ত তিনজন প্রেসিডেন্ট এসেছেন। তাঁদের দুজনই পপুলার ভোটে হেরে যাওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পদে বসতে পেরেছেন। শ্বেতাঙ্গপ্রধান ও দাসপ্রথার পক্ষে থাকা কম জনবসতিপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোর চাপের মুখে যদি সংবিধানে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের বিধান যুক্ত না করা হতো, তাহলে ২০০০ সালে আল গোর এবং ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হতেন। ভোটারদের দমন করে রাখা ও ভোট প্রভাবিত করতে নানা ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়ার নীতির ওপর সুদীর্ঘকাল রিপাবলিকান পার্টির নির্ভর করে চলার কারণেই সংখ্যাগুরুর ইচ্ছার প্রতিফলন সম্ভব হচ্ছে না।
রিপাবলিকান পার্টি দীর্ঘকাল ধরে এই নীতি কেন ধরে রেখেছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তারা জানে, নিকট ভবিষ্যতে আমেরিকার অধিকাংশ লোক হবে অশ্বেতাঙ্গ এবং একুশ শতকের বিশ্ব ও অর্থনীতি পুরুষশাসিত সমাজে আটকা পড়ে থাকবে না। তারা জানে, আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণ—উভয় অঞ্চলের নগর এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা শ্বেতাঙ্গ এবং এই শ্বেতাঙ্গরা সাদা-কালোর বৈচিত্র্যের মূল্যায়ন করতে শিখে গেছেন। এখানকার ভোটারদের মধ্যে সব ধরনের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার মূল্যবোধ জাগ্রত হচ্ছে।
এ অবস্থায় একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যাগুরুর ওপর সংখ্যালঘুর ছড়ি ঘোরানোর একমাত্র উপায় হলো চালাকি। চালাকি দিয়েই বড় বড় করপোরেশন তাদের কর্মী ও ভোক্তাদের ঠকায়, ব্যাংকগুলো তাদের ঋণগ্রহীতাদের ব্যবহার করে। ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক কূটচালে নানা রকম আইনকানুন বানিয়ে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেন।
রিপাবলিকান পার্টিও সেই রকম কূটকৌশল ধরে এগোয়। তারা এখন বেছে বেছে অভিবাসন দেওয়ার নীতি সমর্থন করা থেকে সরে এসে ডেমোক্রেটিক ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখার ফন্দি করছে। রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রিত বহু অঙ্গরাজ্যে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের পরিচয় শনাক্তের শর্তাবলি আরও ভারী করা হয়েছে। কিছু স্থানীয় সরকার ডেমোক্র্যাট-অধ্যুষিত এলাকায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা এবং ভোট গ্রহণের সময়সীমা কমিয়ে দিয়েছে।
সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে ভোটাধিকার প্রয়োগের মতো মৌলিক অধিকার থেকে নাগরিকদের দূরে রাখতেই যেন আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে অফিস-আদালত খোলা থাকার দিনে ভোট গ্রহণ হয়। এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রও আছে। রোববার ছুটির দিনে ভোট হলে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে ভোট দিতে পারেন, কিন্তু অফিস-আদালত ফেলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের পক্ষে ভোট দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্রেরই অরেগন অঙ্গরাজ্যের মতো কিছু জায়গায় নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে ই-মেইল করেও ভোটাররা ভোট দিতে পারেন।
আমেরিকার স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার হয়তো কোনো দিন পূর্ণতা পাবে না, কিন্তু এগুলো এখন সরাসরি আক্রমণের মুখে পড়েছে। এখানে এখন গণতন্ত্র জনগণের জন্য নয়, বরং অল্প কিছু মানুষের জন্য। এখানে এখন ন্যায়বিচার শুধু তাঁদের জন্য, যাঁরা শ্বেতাঙ্গ এবং এই জিনিস কেনার মতো সামর্থ্য রাখেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক