১৭ ও ১৯ মে (২০২২) যথাক্রমে এ কে এম জাকারিয়া ও মহিউদ্দিন আহমদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কৌশল কী হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে প্রথম আলোতে দুটি সময়োপযোগী কলাম লিখেছেন। দুটি কলামেই একটি সাধারণ সূত্রের সন্ধান করা হয়েছে। তঁারা বলতে চেয়েছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুবার দুটি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখলে রেখেছে। এবার অর্থাৎ ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে দলটি নতুন কী কৌশল নিতে যাচ্ছে? উপসংহারে তাঁরা বলেছেন, সেই কৌশল এখনো কারও কাছে পরিস্কার নয়। কৌশল জানা থাকলে পাল্টা কৌশলের ছক কাটা যায়। সময়োপযোগী পাল্টা কৌশল না নিতে পারলে পরিণতি সুখকর হয় না।
গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল বিএনপিসহ সব আওয়ামী বিরোধীকে হারিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের পাল্টাপাল্টি কৌশলের বিশ্লেষণ রেখে একটি বহুলবিশ্রুত ভিনদেশি কৌশলের গল্প বলি।
রাজনীতি ও নির্বাচন করতে কৌশল কাজে লাগে বটে। দেশে আইনের শাসন ও রাজনীতিতে সততা ও স্বচ্ছতা না থাকায় ভোটে জেতার কৌশল আর রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে থাকে না। ক্ষমতা দখলের ‘অপকৌশল’ হয়ে যায়। তা কিছুটা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে।
দুজন আরব এবং দুজন ইসরায়েলি লোক একই ট্রেনের একই বগিতে যাচ্ছেন। দুই আরব দুটো টিকিট কেটেছেন। দুই ইসরায়েলি একটি টিকিট কেটেছেন। আরব দুজন এই ভেবে খুব পুলকিত যে টিকিট চেকার এলেই ইসরায়েলি দুজন পাকড়াও হবেন। চেকার বগিতে ঢুকতেই দুই ইসরায়েলি শৌচাগারে ঢুকে পড়লেন। আরবদের কাছে চেকার এলে তাঁরা টিকিট দেখালেন। শূন্য আসনের যাত্রীরা কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই তাঁরা চেকারকে শৌচাগার দেখিয়ে দিলেন। চেকার শৌচাগারের দরজায় টোকা দিতেই দরজার ফাঁক দিয়ে একটি টিকিট বের হয়ে এল। চেকার টিকিট দেখে আবার ওই ফাঁকে তা ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। দুই আরব এই দেখে ভাবলেন, তাঁদেরও তো একটা টিকিট কাটলেই হতো।
ফিরতি যাত্রায় আরবরা দুজনে একটি টিকিট কাটলেন। দুই ইসরায়েলি দূর থেকে তা দেখলেন এবং এবার তাঁরা কোনো টিকিটই কাটেননি। চারজন যথারীতি একই বগির যাত্রী। আবররা যেই দেখলেন চেকার কামরায় ঢুকছেন, সঙ্গে সঙ্গে দুজন একই শৌচাগারে ঢুকে পড়লেন। একটু পরপর দুই ইসরায়েলির একজন শৌচাগারের দরজায় টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি টিকিট বেরিয়ে এল। দুই ইসরায়েলি ওই টিকিট নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেলেন। এবার টিকিট চেকার এসে যথারীতি শৌচাগারের দরজায় টোকা দিলেন। কিন্তু টিকিট বের হলো না। পরে দুই আরব বিনা টিকিটের যাত্রী হিসেবে পাকড়াও হলেন।
দেশের রাজনীতির অবস্থা হয়েছে সেই টিকিট কাটার মতো। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করার পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থেকে গেলে, তখন সবাই বলল, কী ভুল করলে নন্দলাল! মহা ভুল! মহা ভুল!
২০১৮ সালে ‘ভুল সংশোধন’ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পর বলা হচ্ছে, বিএনপি পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে। নির্বাচনে না গেলেই ভালো হতো। আওয়ামী লীগের কৌশল অনুসন্ধানে ব্যস্ত অনেক বোদ্ধা রাজনীতিক। তাঁরা কৌশল জেনে পাল্টা কৌশল নিতে চান। কিন্তু সে গুড়ে বালি। কারণ, অনেকেই মনে করছেন, কৌশল যা–ই হোক, ফলাফল নির্ধারিত।
রাজনীতি ও নির্বাচন করতে কৌশল কাজে লাগে বটে। দেশে আইনের শাসন ও রাজনীতিতে সততা ও স্বচ্ছতা না থাকায় ভোটে জেতার কৌশল আর রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে থাকে না। ক্ষমতা দখলের ‘অপকৌশল’ হয়ে যায়। তা কিছুটা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে। ব্রিটেনের নানা নির্বাচনে কনজারভেটিভ, লেবার ও লিবারেলদের নির্বাচনী কৌশলগুলো বোঝার চেষ্টা করে আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তারা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় এমন কিছু বিষয় সামনে আনে, যা দিয়ে সমাজের নানা স্বার্থদল (প্রেশার গ্রুপ)–কে আকৃষ্ট করা যায়। তা ছাড়া পেশাদারত্বের সঙ্গে জনমত যাচাই করে নীতি ও কর্মসূচির সংস্কার করে। এটিকে তারা বলে কৌশল।
ব্রিটেনের নির্বাচনী দ্বিদলীয় রাজনীতির একসময় একটি সরল অঙ্ক ছিল। যাঁরা কনজারভেটিভদের ভোট দেন তাঁরা কখনো লেবারকে ভোট দেবেন না। দুই দলেরই নির্দিষ্ট সংখ্যা ও হারের ব্লক ভোট বা ভোটব্যাংক আছে। তাঁরা যেকোনো অবস্থাতেই নিজ দলের বাইরে যাবেন না। মাঝখানে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দোদুল্যমান বা সুইং ভোট আছে। সব দল চেষ্টা করে সে ভোটারদের তুষ্টিকে লক্ষ্য করে নীতি পরিবর্তন করতে। এটাকেও তারা ‘কৌশল ‘বলে।
আমাদের কৌশল পশ্চিমের তুলনায় ভিন্নতর চিন্তা ও ধ্যানধারণায় পুষ্ট ও ভিন্নতর উপাদানে রচিত। যার পেছনে আইনের একটি বাতাবরণ থাকলেও বৈধ আইনগত ভিত্তি খুবই দুর্বল। ক্ষমতা ও প্রভাবের বেআইনি প্রয়োগ তথা ‘শক্তি’ প্রয়োগের বিষয়টি আমাদের দেশের কৌশলের মূল উপাদান। এ দেশে বলা হয় ‘আন্দোলনের শক্তি’ থাকলে দেখাও। আন্দোলনের সরল অর্থ হবে প্রতিবাদ। সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডে কারও সম্মতি বা অসম্মতি, ঘৃণা ও ক্ষোভের প্রকাশ। তা অবশ্যই হবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। এখানে ‘আন্দোলন’ বলতে বোঝায় সহিংস শক্তি প্রয়োগ করে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে আনা। ভোটে অংশগ্রহণ মানে আমাকে জিততেই হবে। ভোটারের ‘মন’ আমাদের ভোট কৌশলে কোনো স্থান পায় না। কারণ লক্ষ্য ভোটার নয়, লক্ষ্য ও প্রয়োজন শুধুই ভোট। সে ভোটে ভোটার এলেও চলে, না এলেও চলে। এটি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা।
২০১৪ ও ২০১৮–তে ভোট নামক আনুষ্ঠানিকতার যে প্রয়োগ, তার ক্ষেত্র ২০১২-১৩ সালেই সম্পন্ন হয়ে যায়। তাত্ত্বিকভাবে ঘোষণা হয়, গণতন্ত্র নয়, দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যদি এ ক্ষেত্রে বাধা হয় তাহলে গণতন্ত্র চাই না। তাই বিচারপতি খায়রুল হকের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’বিষয়ক রায় ও পর্যবেক্ষণ, পরে সংবিধান সংশোধন, তার সঙ্গে মামলা, জেল, গুম, খুন সবই একই সূত্রে গাঁথা। এখন গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আসছে ‘উন্নয়ন’। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পরের বিকল্প ও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও পদ্ধতির মধ্যেই একমাত্র টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
তাই আমার ব্যক্তিগত অভিমত ‘কৌশল’ চিন্তা বাদ দিয়ে সবাই দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি ও দলে গণতন্ত্র আনার চেষ্টা করুন। নীতির চর্চা ও অনুশীলন করে জাতিকে আগামী দিনে একটি সুন্দর, সুশাসন ও ন্যায্যতার বাংলাদেশের বাস্তব স্বপ্ন দেখান। মানুষকে পাশে পাবেন।
● ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও লেখক
E-mail: [email protected]