যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত কনসাল্টিং কোম্পানি ম্যাকেঞ্জির গবেষণা বলছে, ভবিষ্যতে দুই ধরনের নৈপুণ্যের খুব চাহিদা থাকবে—সৃজনশীলতা ও কারিগরি দক্ষতা। প্রত্যাশিতভাবেই বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য কারিগরি নৈপুণ্য বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে। আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীও প্রাথমিক স্তর থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিক্ষা শুরু করার কথা বলেছেন (প্রথম আলো, ২৩ মে ২০১৯)। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই কোডিং ও প্রোগ্রামিং জাতীয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে (প্রথম আলো, ২৪ এপ্রিল ২০২১)।
প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে শিশুদের কারিগরি শিক্ষায় রাতারাতি পারঙ্গম করার দর্শন নতুন নয়। আগেও অনেকে চেষ্টা করেছেন। সাম্প্রতিক (২০০৫) উদাহরণ হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ওয়ান ল্যাপটপ পার চাইল্ড (প্রতি শিশুর জন্য একটি ল্যাপটপ) তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী বিশ্বের গরিব ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে আধুনিক ল্যাপটপ দিলেই হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থী, তাদের নিরক্ষর মা–বাবা এবং প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকেরা বাকিটা নিজে নিজেই শিখে নেবেন।
বৈপ্লবিক এ ধারণার জন্য বিস্তর বাহবা কুড়িয়েছেন কর্মসূচিটির মার্কিন প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক, কেটেছেন অনেক উদ্বোধনী ফিতা। তবে তিক্ত সত্য হচ্ছে ২০১৪ সালের মধ্যেই কর্মসূচিটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়; বন্ধ হয়ে যায় ফাউন্ডেশনের সব কার্যকলাপ। তত দিনে অবশ্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। এ উদাহরণ থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, হুটহাট প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো তৈরি করলেই হবে না, দরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও দক্ষ শিক্ষক।
এই আলোয় বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিতে এবার আসা যাক। বাংলাদেশে এ রকম বড় আকারের কর্মসূচি চালুর আগে আমাদের জানতে হবে, বর্তমানে মফস্বলের স্কুলগুলোতে আইসিটি কোর্স আদৌ পড়ানো হচ্ছে কি না, হলে কতটুকু। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে জানতে হবে, এই কোর্স দেওয়ার ফলে তাদের সেটি পড়াতে বা পড়তে কী কী সমস্যা হচ্ছে।
প্রাথমিকের পরের বছরের পাঠক্রমেই আমরা কোডিং আর প্রোগ্রামিং নিয়ে আসতে চাইছি। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কি আমরা করেছি? তাঁদের কতজনের আইসিটি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাটুকু আছে? কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার আগে আমরা কি আলোচ্য পাঠক্রম আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যাপকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না? আইসিটি সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে বাজেটের প্রয়োজন হবে, আমরা কি নিশ্চিত সেই বাজেট প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে দেব, নাকি পাঠক্রম ধরিয়ে দিয়েই আমাদের কাজ শেষ?
এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তরের আলোয় নীতিমালা প্রণয়ন করলে বোঝা যাবে আইসিটির উন্নয়নে সরকার আসলেই আন্তরিক। শিশুদের জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাদের জন্য যে পাঠক্রম তৈরি করা হয়, সেখানে ভুল করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে সে ভুল যদি হয় যথাযথ বিচার–বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনার অভাবে, তাহলে সেটি চরম দায়িত্বহীনতার উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সারা দেশে আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিদ্যমান আইসিটির কারিকুলাম ঢেলে সাজানো এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে অর্থ বিনিয়োগ করা বেশি জরুরি। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছাড়াই কোডিংয়ের পেছনের যুক্তিতর্ক কিংবা গাণিতিক দক্ষতা আয়ত্ত করানোর বিদ্যা যদি শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে তারা প্রাথমিক স্তর থেকে শিখে আসা সেই কৌশল ব্যবহার করে ভবিষ্যতের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। এ ব্যবস্থায় দূর হতে পারে শহর আর গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্যও
আমরা দুজন কম্পিউটারবিজ্ঞানের অধ্যাপক। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় ব্যয় করেছি আইসিটি নিয়ে পড়াশোনা করে, কোডিং শিখে। এখন আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে আইসিটি শেখানোর কাজে নিয়োজিত আছি। আমাদের প্রত্যেকের বাসায় দুটি করে সন্তান। তাদের বয়স ৫ থেকে ১০–এর মধ্যে। তাদের কাউকে আমরা কম্পিউটারে কোডিং শেখাইনি, শেখানোর কোনো তাগিদও অনুভব করিনি। কেন?
একটি উদাহরণ দিয়ে উত্তরটা দিই। ধরুন, কাউকে আপনি প্রশিক্ষণ দিয়ে কাঠমিস্ত্রি বানাবেন। কাঠমিস্ত্রি হতে হলে বিভিন্ন ধরনের কাঠের গুণগত মান সম্পর্কে জানতে হবে; কাঠ সঠিকভাবে মাপজোখ করা শিখতে হবে; করাত দিয়ে কাঠ কাটতে জানতে হবে, ঘষেমেজে চকচকে করার পদ্ধতি শিখতে হবে, কাঠ রং (বার্নিশ) করা জানতে হবে। ধরুন, কাঠমিস্ত্রির কাজে আগ্রহী কাউকে যদি শুধু করাত চালানো শেখান, তাহলে সারা জীবন সে শুধু করাতই চালাবে, কখনো কাঠমিস্ত্রি হতে পারবে না। আমাদের দেশের সন্তানদের ঢালাওভাবে কোডিং শেখানো অনেকটা কাঠমিস্ত্রি হতে চাওয়া কাউকে শুধু করাত চালানো শেখানোর মতো।
আইসিটির প্রভাব ও দক্ষতা এখন শুধু কোডিংয়েই সীমাবদ্ধ নেই। কোডিং একটা কৌশলমাত্র। আইসিটিতে দক্ষতার এক বড় অংশ জুড়ে আছে গণিতের খেলা, তর্কশাস্ত্র ও পরিসংখ্যানের প্রয়োগ, তুলনার ব্যবহার, পুনরাবৃত্তির ব্যবহার (কোডিংয়ের ভাষায় যাকে বলে রিকারশন বা লুপিং), দর্শন (কোডিংয়ের ক্ষমতাকে জনস্বার্থে প্রয়োগ করতে শেখা), চারুকলার দক্ষতা ও সৃজনশীলতা।
আমাদের মতে, সারা দেশে আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিদ্যমান আইসিটির কারিকুলাম ঢেলে সাজানো এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে অর্থ বিনিয়োগ করা বেশি জরুরি। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ছাড়াই কোডিংয়ের পেছনের যুক্তিতর্ক কিংবা গাণিতিক দক্ষতা আয়ত্ত করানোর বিদ্যা যদি শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে তারা প্রাথমিক স্তর থেকে শিখে আসা সেই কৌশল ব্যবহার করে ভবিষ্যতের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। এই ব্যবস্থায় দূর হতে পারে শহর আর গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্যও।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা শুধু করাত চালানো শেখাব, নাকি দক্ষ কাঠমিস্ত্রি হিসেবে গড়ে তুলব, নির্ভর করবে বর্তমানে আমাদের নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর। সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যথার্থ নীতিমালা এক হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মই হয়ে উঠতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
● ড. বি এম মইনুল হোসেন সহযোগী অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
● এহসান হক, সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটারবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার, যুক্তরাষ্ট্র