গিয়েছিলাম রংপুর জেলায়। কাজ করছি তিনটি উপজেলায়, তার মধ্যে বদরগঞ্জ একটি। দেশের যে ২৪টি উপজেলায় ২৮ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচন হচ্ছে, তার মধ্যে বদরগঞ্জ একটি। এই নির্বাচন নিয়ে উপজেলা শহরের অনেকেই ব্যস্ত। রাস্তায় দেখা গেল অনেক গ্রাম পুলিশ সদস্য। তাঁরা আগের দিনই এসেছেন নির্বাচনী কাজে সহযোগিতা করতে। গবেষণার জন্য যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা, তাঁরা বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি। কেউই খুব বেশি সময় দিতে পারছেন না। তাঁদের বাইরেও আছেন কয়েকজন।
প্রথমে যে বৃদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিলাম, এলাকায় অনেকেই তাঁকে চেনেন একজন প্রবীণ মানবিক মানুষ হিসেবে। কেন এসেছি, ওনার কাছে কী জানতে চাই, তা খোলাসা করতেই তিনি বললেন, তিনি এখন বেশির ভাগ সময়ই চুপ থাকেন। খুব সাবধানে মতামত দিতে হয়। কী বলে আবার কী বিপদে পড়েন! বললেন, ‘এখন কথা না বলাই ভালো। জানতে চাইলেন, কথা বললেও কি মনের কথা বলতে পারবেন? কথা তো বলতে হবে অন্যকে খুশি করার জন্য কিংবা আশপাশ ভেবে।’ বৃদ্ধ বয়সে এতটা চাপ নিতে চান না তিনি । জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাঁর এই মনের বাইরে কথা আসলে আমার গবেষণার কোনো কাজে লাগবে কি?’
আমার পাশে বসে যখন আরেকজন টেলিফোনে একটি সাক্ষাৎকারের সময় ঠিক করছিলেন, তখন ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বলছেন, ‘ভোটের প্রস্তুতি, প্রচারণা তো আছে, ভোট দিতে পারবনি?’ তিনিই আবার ফোন রেখে হাসতে হাসতে আমাকে বলেন, ‘আগে যারা বিরোধী দল করত এখন তারাই আওয়ামী লীগের প্রচারণা করছে, এখন তো সবাই সরকারি দল। এখন সরকারি দল বাদে অন্য পক্ষ সমর্থন দিলে খবর আছে আপা! এলাকায় থাকা যাবে না। তাই মনে যা–ই থাকুক মুখে মুখে সবাইকে অন্য জনের কথা বলতে হচ্ছে।’
এই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে কি কোনোভাবেই আমরা বের হতে পারব না? আর বের না হতে হতে আমরা কি আরও ভয়ের গর্তে পড়ে যাব? এই ভয় কাটানোর, তাড়ানোর দিকেই আমাদের এখন ঝুঁকতে হবে সবচেয়ে বেশি।
যদিও একটি এলাকার স্থানীয় নির্বাচন আমার গবেষণার বিষয় ছিল না, কিন্তু এই সময়ে নির্বাচনী এলাকায় আসার কারণে সেই নির্বাচন নিয় জনগণে শঙ্কা দেখতে পেলাম। উত্তরবঙ্গের একটি মফস্বল এলাকায় ‘সাধারণ’ মানুষ এতটা ভয়ে আছে, তা আমরা ঢাকা শহরে বসে কখনো সেভাবে অনুমান করতে পারি না।
একটা অব্যক্ত চাপ বোধ করছেন অনেকেই। কেউ তা প্রকাশ করছে, কেউ হয়তো ভাবছে এটিও বলা যাবে না। কেনইবা মানুষ নিজের মতো কিংবা নিজে যা ভাবছে, তা বলতে পারছে না।
আসলে ঢাকা, মফস্বল এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। কোনো কোনো বিষয় আসলে এমন প্রশ্নহীনভাবেই চর্চিত হয়, যে সেটি একটা সময় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। আসলেই কি পুরো দেশে তাহলে একটি ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে? নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকার এবং তা নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা এবং ভয় সত্যিই কি তাহলে মানুষের মনে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে?
বাক্স্বাধীনতা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি অধিকার নিজের মতটি নিজের মতো করেই প্রকাশ করার। এখন মানুষ হয়তো কথা বলছে, কিন্তু নিজের মতামত কি সব সময় নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারছে?
একজন উত্তরদাতা নারী বলছেন, ‘কার কাছে নিপীড়নের বিচার দেবেন? কেউই কোনো কিছু এখন বেশি গুরুত্ব দেয় না, সবার কাছে বড় হলো রাজনীতি। শুধু এখন দল করলেই লোক কথা শোনে। আমরা সাধারণ, তাই আমাদের কেউ নেই।’
কাদের কাছে গিয়েছেন? এটি যখন জানতে চাইলাম, তখন তিনি আর জবাব দেননি। বললেন, ‘তাই কি বলা যাবে?’
এই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে কি কোনোভাবেই আমরা বের হতে পারব না? আর বের না হতে হতে আমরা কি আরও ভয়ের গর্তে পড়ে যাব? এই ভয় কাটানোর, তাড়ানোর দিকেই আমাদের এখন ঝুঁকতে হবে সবচেয়ে বেশি।
তোষামোদি সংস্কৃতি এই ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাহেব যখন বলেন চমৎকার, মোসাহেবরা বলছেন, অমত কার? কিন্তু অমত থাকলেও সাহেবদের ভয়ে কেউ সেটি জানাতে পারছে না। তাই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার প্রধান শর্ত হলো তোষামাদি সংস্কৃতির সেবক না হওয়া। সেখান থেকেই বের হতে হবে প্রথমে।
জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
[email protected]