২০১২ সালে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ শতাংশে। এবার হঠাৎ করে নেমে এল ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার। এটা কী প্রমাণ করে? নির্বাচনের প্রতি কি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়রের পাশাপাশি কাউন্সিলর পদেও প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে একজন করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর বাইরে সংরক্ষিত আসনে ৯ জন নারী কাউন্সিলর হবেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতীয় সংসদে নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা না করতে পারলেও স্থানীয় সরকার সংস্থায় করেছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নারী সদস্যরাও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। কিন্তু এরপর আর আমরা ওমুখো হইনি। তঁাদের সংরক্ষিত করে রেখেছি। নারীর ক্ষমতায়নকে নারী নেতৃত্বও ভয় পান।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, ভোটের বিষয়ে তাঁদের উৎসাহ কম। প্রথমত, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে বড় কোনো দলের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না। দ্বিতীয়ত, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছে। দলের যে দুই নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাঁদেরও বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আগে সিটি করপোরেশনসহ সব স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হতো নির্দলীয়ভাবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এটিকে রাজনৈতিক রূপ দিয়েছে। এতে মনোনয়ন-বাণিজ্য বাড়লেও গণমানুষের কোনো লাভ হয়নি।
সাম্প্রতিক কালে প্রায় সব স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হয়েছে একতরফা। বিনা ভোটে জয়ের ঘটনাও আছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনেও দুটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন ভোট চান না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। এই রীতি বিশেষ বিশেষ স্থানে না করে সারা দেশে এবং সব পর্যায়ে করা হলে জাতি দুভাবে লাভবান হতে পারে। এক. নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন হবে না। দুই. নির্বাচনের নামে কোটি কোটি টাকাও খরচ হবে না।
জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বিএনপি কুমিল্লা নির্বাচন বর্জন করেছে। সিটি নির্বাচন মাথায় থাকলে তারা এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। গত দুই নির্বাচনে তাদের মনোনীত ও সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হন। এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে কি ফলাফল ভিন্ন হতো? অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে এলে তাদের প্রার্থী অনায়াসে জিতে যেতেন। নির্বাচনের ভোটের হিসাবে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ প্রার্থী যে ভোট পেয়েছেন, বিএনপির বহিষ্কৃত দুই প্রার্থীর ভোটের সংখ্যা তার দেড় গুণ। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০, স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক ৪৯ হাজার ৯৬৭। মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর হাতপাখায় পড়েছে ৩ হাজার ৪০ ভোট। এই দল স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ২ থেকে ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে থাকে। কুমিল্লায়ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর ভোটের হার ২ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ বাম দলগুলো প্রার্থী দিলে ১ শতাংশ ভোটও পান না। এর কারণ, দেশের মানুষ ডানপন্থী হয়ে যায়নি। বামেরা বিভক্ত হতে হতে নিজেদের শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। শুরু থেকে কুমিল্লায় ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল। কোনো উত্তেজনা বা উৎকণ্ঠা ছিল না। প্রার্থীরা নির্বিঘ্ন প্রচার চালিয়েছেন। এরপর ভোটের দিনের চিত্রও ভালো ছিল। ইভিএম নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তা-ও ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার মতো নয়।
ভোটের ব্যবধান যত কম হোক না কেন, কুমিল্লায় নৌকা প্রার্থীর জয়কে আওয়ামী লীগ নিজের বিশাল জয় হিসেবে দেখাতে চাইবে। গত দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের কারণ ছিল দলের বিভক্তি। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরে দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের গ্রুপ, অন্যদিকে প্রয়াত নেতা আফজল খানের গ্রুপ। আফজল খান মারা যাওয়ার পর তাঁর গ্রুপ অনেকটা হীনবল। অন্যদিকে আফজল খানের কন্যা আঞ্জুম সুলতানা গত সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর দল তাঁকে পুরস্কার হিসেবে সংরক্ষিত আসনে জাতীয় সংসদের সদস্য করেছে। এবার সিটি করপোরেশনে মনোনয়ন পান বাহাউদ্দিন গ্রুপের। ফলে নির্বাচনটি কেবল দলের নয়, বাহাউদ্দিনের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
এই নির্বাচনে তিনি একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন এ কথা বলা যাবে না। আওয়ামী লীগের দলীয় ভোট বাড়েনি। বরং বিএনপির বিভক্তির সুবিধা নিয়েছেন আরফানুল। আগের দুই নির্বাচনে যেমনটি পেয়েছিল বিএনপি। আমাদের দেশের রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির মহিমাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। অনেকে নিজেকেই দল মনে করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে যে পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে, সেটা স্বীকার করতে চান না। আবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের সংযত মনোভাব থাকত কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ করেছেন কেউ কেউ।
কুমিল্লার বেশির ভাগ মানুষ মনে করতেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে দ্বিমুখী। নৌকার আরফানুল ও টেবিল ঘড়ির মনিরুলের মধ্যে। অথচ ফলাফলে নিজামউদ্দিন তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এ বিষয়টি সাবেক মেয়র আমলেই নেননি। আমরা যখন তাঁর সঙ্গে বিএনপি ঘরানা থেকে একাধিক প্রার্থী কেন প্রশ্ন তুলি, তিনি বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, নিজামউদ্দিনের কোনো সমর্থনই নেই। অথচ ভোটের হিসাব বলে দেয়, তঁার অবস্থান বেশ শক্ত। যেসব এলাকা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, সেসব এলাকায় তিনি বেশি ভোট পেয়েছেন। নিজামউদ্দিন তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের কর্মসংস্থান ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা বলেছিলেন।
নির্বাচন কমিশন আগে বলেছিল কুমিল্লা সিটি নির্বাচন তাদের প্রথম পরীক্ষা। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জেগেছে, পরীক্ষায় তাঁরা কেমন করলেন? স্কুলে থাকতে আমরা পরীক্ষা খারাপ হলে বলতাম, মোটামুটি হয়েছে। আর ভালো হলে বলতাম, খুব ভালো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। শুরু থেকে কুমিল্লায় ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল। কোনো উত্তেজনা বা উৎকণ্ঠা ছিল না। প্রার্থীরা নির্বিঘ্ন প্রচার চালিয়েছেন। এরপর ভোটের দিনের চিত্রও ভালো ছিল। ইভিএম নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তা-ও ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার মতো নয়।
কিন্তু যে বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে, তা হলো নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে না পারা। তঁারা স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়ার চিঠি দিয়েছেন। তিনি আমলে নেননি। এরপর তিনি নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছেন। এতে মনে হয়েছে, কমিশনের চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যই ক্ষমতাবান। যে সিদ্ধান্ত তাঁরা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, সেই সিদ্ধান্ত কেন নিলেন? সুষ্ঠুভাবে সারা দিন ভোট গ্রহণের পর গণনার সময় সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও জনমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টিতে ৬০০ ভোটে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর হঠাৎ করে বাকি চারটিতে ৩৪৩ ভোটে পিছিয়ে পড়াও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি অনেকের কাছে। মনে হয়েছে নির্বাচন কমিশন তীরে এসে তরি ডুবিয়ে দিয়েছে। এসব কারণেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ।’
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের বিতর্ক ফল ঘোষণার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে না। এর রেশ চলতে থাকবে আরও অনেক দিন।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি