বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪টি মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান, যেগুলোর কাজ সম্পন্ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চমকপ্রদ গতিশীলতা অর্জন করবে—পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইন, যমুনা রেলসেতু, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন।
কিন্তু এই ১৪ প্রকল্পের মধ্যে এমন কয়েকটি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেগুলো গ্রহণে সত্যিকার জাতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজনের চেয়ে সরকারের নানা বিবেচনা ও খেয়ালখুশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে নিছক কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোর যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণকে ত্বরান্বিত করা। এ জন্য প্রয়োজন প্রকৃত প্রকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে সত্যিকারের গ্রহণযোগ্য প্রকল্প নির্বাচন।
বিচার-বিবেচনাহীন প্রকল্পের উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রসঙ্গটি। প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই নির্মীয়মাণ প্ল্যান্ট প্রকল্প মূল্যায়নের পদ্ধতি প্রয়োগ করে কখনোই গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা যাবে না। কারণ, ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে পাওয়া যাবে, যেখানে এর অর্ধেকের কম ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক বেশি নিরাপদে উৎপাদন করা যাবে। রাশিয়া থেকে এ প্রকল্পের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এ ঋণের লোভে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এ রকম একটা ব্যয়বহুল প্রকল্প বাংলাদেশ কেন গ্রহণ করল? সবচেয়ে বড় কথা, পারমাণবিক প্রকল্পের মতো একটা মহা বিপজ্জনক প্ল্যান্ট বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের সীমানার একেবারে মাঝখানে পাবনার রূপপুরে স্থাপিত হওয়া আদৌ কি গ্রহণযোগ্য?
পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্ঘটনা খুব বিরল নয়।
প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্য হলো একটু অসাবধান হলেই পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে বিপজ্জনক বিকিরণ হতে পারে, যা প্ল্যান্টের আশপাশের এলাকার জনগণের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এর মানে, পারমাণবিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি দেশের জন্য নিরাপদ বিবেচিত হতে পারে না। অথচ আমাদের নীতিপ্রণেতারা এই মহা বিপজ্জনক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন। বলা হচ্ছে, প্রকল্প চালু হওয়ার ২০ বছরের মধ্যেই রাশিয়ার ঋণ সুদ-আসলে শোধ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এ প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় প্রাক্কলিত ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের চেয়ে না বাড়লেও ‘গরিবের এই ঘোড়ারোগ’ কখনোই প্রশংসনীয় বিবেচিত হবে না। রাশিয়া থেকে ঋণ পেয়েছি বলেই এমন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প নেওয়া কখনোই যুক্তিসংগত প্রমাণ করা যাবে না। এখন শোনা যাচ্ছে, পটুয়াখালীর আরেকটি জায়গায় গণচীনের অর্থায়নে দ্বিতীয় পারমাণবিক প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষান্ত দেন! ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারে আরও অনেক বেশি জরুরি প্রকল্প গ্রহণ বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কলামে সে সম্পর্কে আলোকপাত করছি।
একটু অসাবধান হলেই পারমাণবিক প্ল্যান্ট থেকে বিপজ্জনক বিকিরণ হতে পারে, যা আশপাশের এলাকার জনগণের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এর মানে, পারমাণবিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি দেশের জন্য নিরাপদ বিবেচিত হতে পারে না। অথচ আমাদের নীতিপ্রণেতারা এই মহা বিপজ্জনক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
দ্বিতীয় যে কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পের উল্লেখ করব, সেটা হলো ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইন। পদ্মা সেতু দিয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রেললাইন অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। অথচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। যমুনা রেলসেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে বর্তমান বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর রেলপথের সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে। তৃতীয় যে প্রকল্পটি যৌক্তিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না তা হচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের পুরো সামর্থ্য এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও এর পুরো ব্যবহার করতে পারছি না, অন্য কোনো দেশের কাছে এই স্যাটেলাইটের উদ্বৃত্ত সক্ষমতাও বিক্রি করতে পারছি না। অথচ এখন কৃষি খাতে ব্যবহারের অজুহাত দিয়ে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রয়োজন প্রশ্নসাপেক্ষ। এসব প্রকল্পের চেয়ে নিচের জরুরি প্রকল্পগুলো কি বেশি অগ্রাধিকার দাবি করে না?
১. বাংলাদেশের একমাত্র অয়েল রিফাইনারি চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৫ লাখ টন ক্যাপাসিটি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ টন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানি করছে। এর মানে, প্রতিবছর এখন ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন রিফাইনড পেট্রোলিয়াম পণ্য বাংলাদেশকে সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে এবং এ বাবদ প্রতিবছর অতিরিক্ত মূল্য হিসেবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে। ইস্টার্ন রিফাইনারির বয়স এখন ৫৩ বছর, এর ‘ইকোনমিক লাইফটাইম’ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টন ক্যাপাসিটির একটি অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা দেশের জন্য ফরজ হয়ে গেছে। অথচ আমরা দেখছি এ ধরনের রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি প্রায় এক দশক ধরে ঝুলে রয়েছে।
২. তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা জরিপ এক বছর আগেই সম্পন্ন হয়েছে এবং চীনকে নাকি এই প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। অথচ
ভারতের বিরোধিতার কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ভারত যদি তাদের ‘চিকেন নেক করিডর’ এবং ‘সেভেন সিস্টার্সের’ নিরাপত্তার অজুহাতে চীনকে এই প্রকল্পে কাজ করতে দিতে নারাজ থাকে, তাহলে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে কিংবা অন্য কোনো দেশের সহায়তায় এ মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? তিস্তা অববাহিকার জনগণের অবর্ণনীয় দুর্দশা লাঘবের স্বপ্ন দেখানো এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় স্বল্প সময়ের মধ্যেই সুদ-আসলে উঠে যাবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
৩. বাংলাদেশে এখনো একটি পেট্রো কেমিক্যাল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অথচ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। একটি পেট্রো কেমিক্যাল কমপ্লেক্স থেকে কৃত্রিম তন্তু উৎপাদন করা গেলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের সংস্থান হয়ে যাবে—এটা কি সরকারের জানা নেই? (অবশ্য মহেশখালীতে একটি বিদেশি কোম্পানি একটি পেট্রো কেমিক্যাল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বরাদ্দ নিয়েছে)।
৪. বাংলাদেশে এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। পাকিস্তান আমলের লোকদেখানো সীমিত সক্ষমতার ইস্পাত কারখানাটি বিশ্বব্যাংকের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচির আওতায় বন্ধ করে দেওয়ার পর দুই দশকেও এ ব্যাপারে সরকারের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি দেখে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে ইস্পাতদ্রব্যের জন্য বিদেশের ওপর শতভাগ নির্ভরতা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। আর প্রতিবছর মৌলিক ইস্পাতদ্রব্য আমদানির জন্য আমাদের কত হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে, সেটা কি কখনো হিসাব করা হয়েছে?
৫. ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশের পদ্মা নদী এবং দক্ষিণাঞ্চলের অনেক শাখা নদী শুষ্ক মৌসুমে মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে যায়। উপরন্তু, কুষ্টিয়া, যশোর, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার অনেক এলাকায় নদীর লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সমস্যা সংকটে পরিণত হয়ে গেছে। প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প এই সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধান হিসেবে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় অভিমত পাওয়ার পর প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এ প্রকল্প কেন অনুমোদন পাচ্ছে না, সেটা এক বড় প্রশ্ন। এই অতি প্রয়োজনীয় প্রকল্পটির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনা কামনা করছি।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক