‘খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চায়’ ডয়চে ভেলের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। কয়েক দিন আগে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে আমি এতে অংশ নিই। আলোচনার একপর্যায়ে কার্টুনিস্ট কিশোরকে নির্যাতনের প্রসঙ্গ ওঠে। প্রায় মাস দশেক আগে অজ্ঞাতনামা কিছু ব্যক্তি তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। কিশোর জানিয়েছে, সরকারের সমালোচনামূলক কার্টুন আঁকার অভিযোগে চড় মেরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তার কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয় এবং লোহার পাত বসানো লাঠি দিয়ে দুপায়ে প্রচণ্ড প্রহার করে। ১০ মাস পরও এসব আঘাতের চিহ্ন ও আলামত সে বহন করে চলেছে। একই সময় আটক হওয়া লেখক মুশতাককে নির্যাতনের যে বিবরণ কিশোর দিয়েছে, তা আরও পাশবিক, বর্বরোচিত, অমানুষিক।
জনাব ইনুর মনে হলো তিনি কিশোরের এই বিবরণে পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত নন। তঁাকে অনুরোধ করলাম, আপনি তাকে নিজে গিয়ে দেখে আসেন, নির্যাতনের চিহ্ন পেলে সংসদে প্রশ্ন তোলেন। তিনি ভেবে দেখবেন বললেন। এরপর তিনি বা অন্য কোনো সংসদ সদস্য কিশোরকে দেখতে গেছেন, এমন কোনো সংবাদ আমরা পাইনি। এমনকি দেশে যে একটা মানবাধিকার কমিশন আছে, তারাও সরেজমিনে বিষয়টি তদন্ত করার গরজ অনুভব করেনি।
কিশোরকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তিন দিন আটকে রেখে চরম নির্যাতন করে। একপর্যায়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাকে থানায় দিয়ে এলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তার সঙ্গে আটক হওয়া মুশতাকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এর আগে সাংবাদিক কাজলকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা আটক করে রাখে কয়েক মাস। এমন ঘটনা বিএনপির বিভিন্ন নেতা-কর্মীর ক্ষেত্রে ঘটেছে, ঘটেছে রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার ক্ষেত্রে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা প্রায় একই কায়দায় এমন শত শত মানুষকে গত কয়েক বছরে তুলে নিয়ে গেছে। তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশ এখনো নিখোঁজ আছেন, কারও কারও লাশ পাওয়া গেছে পরে। সৌভাগ্যবানদের কাউকে কাউকে বাসায় ফিরতে দেওয়া হয়েছে, কাউকে কাউকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।
অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের খপ্পর থেকে যাঁরা ফিরে এসেছেন বা পরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ ভয়াবহ নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন। যাঁরা ফিরে আসেননি, তাঁদের পরিবার-পরিজন কান্নার সাগরে ভেসে প্রতিবছর তাঁদের খোঁজ চেয়ে অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন প্রেসক্লাবে। আমার মনে পড়ে, এমন একটি অনুষ্ঠানে একজন বাবা বলেছিলেন, তাঁর ছেলেকে যদি মেরেও ফেলা হয়ে থাকে, তিনি কোনো বিচার চাইবেন না। তিনি শুধু জানতে চান কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে ছেলের লাশ। সেখানে গিয়ে দোয়া পড়ে আসতে চান তিনি।
হৃদয়বিদারক এমন বহু আর্তির পরও কেউ খোঁজ করেনি বুকে হিম ধরানো এসব অজ্ঞাতনামা কারা?
২
এই অজ্ঞাতনামা কারা তার কিছু আলামত অবশ্য আমরা পাই ঘটনাগুলোর বিবরণে, বিশ্লেষণে। কিছু ক্ষেত্রে তুলে নেওয়া ব্যক্তি, তার পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীরা বিভিন্ন বাহিনীর যানবাহনে করে তাদের তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। প্রশ্ন আসে: সরকারি বাহিনী এর সঙ্গে জড়িত না হলে পুলিশ কেন এমন আচরণ করবে?
অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তুলে নেওয়ার পর ফিরে আসার যে ১০-১২টি ঘটনা ঘটেছে, তার একটিতেও ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পাননি। বরং প্রায় সবাই ঘটনাটি ভুলে গেছেন বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব ছিল তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের হদিস বের করার চেষ্টা করা। সরকার তা করেনি। এসব ঘটনার জন্য সরকার দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে, অভিযোগের আঙুল উঠেছে সরকারের দিকেই। তবু কেন সরকার চেষ্টা করেনি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের পরিচয় জানার?
আর এই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়ার শিকার কেন শুধু বিরোধী দল, ভিন্নমতাবলম্বী মানুষ বা সরকারের সমালোচনাকারীরাই হয়?
৩
তুলে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় কয়েকটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের উপাদান রয়েছে। এতে অপহরণ, অপবাহন, গুরুতর আঘাত, অন্যায়ভাবে আটকে রাখা প্রভৃতি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অজ্ঞাতনামারা সরকারি লোক হলে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার আগের সময়টিতে সংঘটিত জঘন্য অপরাধটি আসলে গুম।
২০০৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে গুম হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী বা এর সমর্থনে কাউকে অপহরণ, আটক ও বন্দী করা এবং এসব অস্বীকার করা, যাতে ওই ব্যক্তি কোনো আইনগত সুরক্ষা পেতে না পারেন। ২০০২ সালের রোম স্ট্যাটিউট অনুসারে রাষ্ট্রীয় কোনো নীতির আলোকে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণির বিরুদ্ধে এটি পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হতে থাকলে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ। বাংলাদেশ রোম স্ট্যাটিউটের পক্ষরাষ্ট্র, কিন্তু গুমবিষয়ক চুক্তির নয়। তাই বলে মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক নজরদারি ব্যবস্থাগুলোতে গুমের দায় ও সমালোচনা থেকে সরকার মুক্তি পায়নি।
নির্যাতনবিষয়ক ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ তার প্রথম প্রতিবেদনটি ২০১৯ সালে জমা দেয়। এই চুক্তির অধীনে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্য বিবেচনা করে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশের কাছে তার চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ প্রদান করে। সেখানে বলা হয়, নির্যাতন ও গুমের অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ভুক্তভোগী ও তাঁদের স্বজনকে হুমকি দিয়ে বা হয়রানি করে মামলা করা থেকে বিরত রাখে। সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি কর্তৃক গুমের অগণিত ও একই ধরনের তথ্য পাওয়ার কথা বলা হয়, বলা হয় যে এগুলো তদন্ত করা হচ্ছে কি না, বাংলাদেশ সরকার তার কোনো তথ্য কমিটিকে প্রদান করেনি। কমিটি বাংলাদেশকে যেসব পরামর্শ দেয় তার মধ্যে গুম, নির্যাতন বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন, গুমবিষয়ক কনভেনশন অনুসমর্থন ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের নিয়ে আটক রাখার স্থানগুলো পরিদর্শনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
২০১৮ সালের মে মাসে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল কর্তৃক ইউপিআর রিভিউয়ের সময় কিছু খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশে গুমের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ করে। রিভিউয়ের সুপারিশেও বাংলাদেশকে গুমবিষয়ক চুক্তি অনুসমর্থনের সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশে অন্য বহু সুপারিশের ক্ষেত্রে সমর্থন জানালেও এ ক্ষেত্রে শুধু নোটেড (দেখা হলো) বলে মন্তব্য করে প্রকারান্তরে তার অনীহা জানিয়ে দেয়।
৪
সরকার বলে থাকে, গুম নামে কোনো অপরাধ বাংলাদেশে নেই। গুমের সঙ্গে অপহরণ ও নির্যাতনের মতো যে অপরাধগুলো থাকে, সরকার তা-ও সাধারণত তদন্ত করে না। আর গুমের বিষয়ে কোনো আইনি নির্দেশনা নেই, তা-ও ঠিক নয়। অন্তত দুটো মামলায় (ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ ও সাইফুজ্জামান বনাম বাংলাদেশ) উচ্চ আদালত গ্রেপ্তার ও আটকসংক্রান্ত যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তা মেনে চললে গুম করা দুষ্কর হবে। এসব নির্দেশনায় কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় অবশ্যই চাহিবামাত্র পরিচয়পত্র দেখানো, গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে কারণ জানানো, বাসা বা অফিস থেকে গ্রেপ্তার করা না হলে থানায় আনার এক ঘণ্টার মধ্যে পরিবারকে গ্রেপ্তারের বিষয় জানানো ও নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সমস্যা হচ্ছে সরকার অনেক ক্ষেত্রে স্রেফ তুলে নেওয়ার ঘটনাই অস্বীকার করছে। মানবাধিকার কমিশন, উচ্চ আদালত, সংসদীয় কমিটি কেউ সরকারকে এ ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
আমরা শুধু জানছি যখন-তখন যেকোনো জায়গা থেকে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা। কেউ চরম নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসে, কেউ কখনো ফিরে না। আমরা শুধু জানছি এ অজ্ঞাতনামাদের বিচারের আওতায় আনার গরজ রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই।
আমাদের তাই অধিকার আছে এটি ভাবার যে এই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ। এই ভাবনা চরম হতাশাজনক, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটি অনেক বড় একটি লজ্জা।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক