কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর আগুনঝরা কবিতা: ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ হতে ধার করে আজ আমরাও তাঁরই মতো বলতে বাধ্য হচ্ছি ‘কাঁদতে আসিনি, রাষ্ট্রের কাছে জবাব চাইতে এসেছি।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মদিনে সমগ্র জাতি যখন দেশব্যাপী মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের উৎসবে মাতোয়ারা, তখন (১৭-৩-২০২১) সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হাবিবপুর ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে সন্ত্রাসী হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে হাওরে পালিয়ে যাতে বাধ্য হন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
ঘটনা সম্পর্কে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বিবিসিকে বলেন, হেফাজত ইসলামের নেতা মামুনুল হককে নিয়ে এক হিন্দু ব্যক্তির স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে কয়েক হাজার মানুষ বুধবার (১৭-০৩-২০২১) সকালে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায়। তারা অন্তত ৮৮টি বাড়িঘর ও ৭-৮টি মন্দির ভাঙচুর ও লুটতরাজ করে। আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। বর্তমানে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও গেছেন। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সোমবার (১৫-৩-২০২১) পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলায় একটি ধর্মীয় সমাবেশে বক্তব্য দেন হেফাজত ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক।
এ সমাবেশের পরদিন নোয়াগাঁও গ্রামের একজন হিন্দু যুবক মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ স্ট্যাটাসের প্রতিবাদে স্থানীয় হেফাজত ইসলাম মঙ্গলবার (১৬-৩-২০২১) বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সে রাতেই (১৬-৩-২০২১) অভিযুক্ত যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং বুধবার সকালে কোর্টে চালান দেয়। কিন্তু এরপরও ওই যুবকের গ্রামটিতে হামলা চালানো হয়। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, এই হামলার তদন্ত করে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একই ছক, একই অভিযোগ এবং একই কায়দায় বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বক্তব্য ও প্রতিকারের ধারাটিও প্রায় অভিন্ন —তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের রামুতে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শত শত বছরের পুরোনো ১২টি বৌদ্ধ বিহারের বিরল বৌদ্ধমূর্তি, মন্দির এবং বৌদ্ধপল্লির ৪৫টির মতো বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রামুর ঘটনার এক বছর পর ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুপল্লি বনগ্রামে বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়। সাঁথিয়ায় হামলার ৬ মাস যেতে না যেতেই একই কায়দায় ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কুমিল্লার হোমনা উপজেলার সীমান্তবর্তী বাঘসীতারামপুর হিন্দুপ্রধান গ্রামের বাড়িঘর, মন্দির ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। হোমনার পর ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ৮টি হিন্দুপাড়ায় অন্তত ৩০০টি বসতবাড়ি ও ১০টি মন্দিরে হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট করা হয়। বহুল প্রচারিত এই ঘটনার এক মাস পর ৪ নভেম্বর নাসিরনগরে আবারও হিন্দু বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ৬টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নাসিরনগর হামলার এক বছর পর ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়া ঠাকুরপাড়ায় হামলা চালিয়ে ১৫টি হিন্দু বাড়ি লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এর পরের ঘটনা ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঈদগাহ মাঠ। তৌহিদী জনতার ব্যানারে তাণ্ডব ও পুলিশের গুলিতে ৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। ভোলার ঘটনার এক বছর পর আবারও ২০২০ সালের ১ নভেম্বর কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কোরবানপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়। এই লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটল ১৭ মার্চ ২০২১ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ফেসবুক হ্যাক করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, পবিত্র কোরআন শরিফের অবমাননা অথবা মহানবী (সা.) কে কটূক্তির মিথ্যা অভিযোগে এলাকায় প্রথমে প্রশাসনের উপস্থিতিতে মিটিং, মিছিল, দেশত্যাগের হুমকি ইত্যাদি এবং এর দু-এক দিন পর নির্বিচারে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে।
প্রসঙ্গত, ভোলা বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘটনার দিনই (২০ অক্টোবর ২০১৯) গণভবনে আওয়ামী যুবলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের সূচনা বক্তৃতায় অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘একজন মুসলিম হয়ে কীভাবে মহানবী (সা.) সম্পর্কে খারাপ কথা লিখে অন্যকে ফাঁসায়, তা আমার বোধগম্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, কেউ যদি সত্যিকার ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, যদি তাদের নবী করিম (সা.)-এর প্রতি এতটুকু সম্মান থাকে, তাহলে আরেকজনের ক্ষতি করার জন্য এই ধরনের জঘন্য কথা কীভাবে লেখে?
ভোলায় একটি হিন্দু ছেলের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। রামু-সাঁথিয়া-হোমনা-নাসিরনগর-গঙ্গাচড়া-ভোলা সব জায়গার একই চিত্র। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও না কারও ফেসবুক হ্যাক করে অথবা ভুয়া মেসেজের স্ক্রিনশট ভাইরাল করে এই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে, যার একটিতেও কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। প্রশাসন আজ পর্যন্ত একটিরও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বীকার করেছে অভিযুক্ত নির্দোষ। তারপরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে।
সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনাটি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। জেলা প্রশাসকও বলেছেন, তথাকথিত অভিযোগটি ছিল হেফাজত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক স্ট্যাটাস। লক্ষণীয়, এখানে পবিত্র কোরআন শরিফ, মহানবী (সা.) অথবা ইসলাম ধর্মকে নিয়ে নয়, স্ট্যাটাসটি ছিল হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বক্তব্যের প্রতিবাদ মাত্র। এটাও কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত?
ধর্মীয় অনুভূতি কি ওয়ানওয়ে ট্রাফিক? বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্নটি রাখতে চাই, বিশেষ একটি ধর্মাবলম্বীরই কি কেবল অনুভূতি আছে? অন্য ধর্মাবলম্বীর নেই? বিভিন্ন ঘটনায় মন্দিরে হামলা হচ্ছে, প্রতিমা ভাঙচুর হচ্ছে, দেবোত্তর সম্পত্তি জোর করে দখল করে নেওয়া হচ্ছে, অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে মন্দির-দেবস্থলিতে। এতে কি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে না? অনেক ওয়াজ মাহফিলে কিছু কিছু বক্তা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম ও ধর্মাচার নিয়ে যেভাবে কুৎসা, মিথ্যাচার, ঘৃণা ছড়ান, তা কি ধর্মানুভূতিতে আঘাত নয়? রাষ্ট্রের কাছে এর জবাব চাই।
কাজল দেবনাথ বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি।