বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে কার্যত বন্ধ আছে। প্রায় চার কোটি স্কুলগামী শিশু বর্তমানে বিবর্ণ এক শৈশব পার করছে। ঘরে বসে অনলাইনে কিংবা দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে লেখাপড়া কিছুটা চলমান থাকলেও প্রায় শতভাগ শিশুই শারীরিকভাবে স্কুলে যেতে পারছে না। এমনিতেই শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও বিনোদনের সুযোগ। স্কুল খোলা থাকলে তবু স্কুলে যাওয়া-আসার প্রয়োজনে ওরা ঘরের বাইরে বের হতে পারে। শিক্ষক ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, তৈরি হয় ভাব বিনিময়ের সুযোগ। প্রায় ১৫ মাস ধরে এই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডগুলো থেকেও বঞ্চিত শিশুরা। অপূরণীয় এই ক্ষতির শেষ কবে ও কীভাবে হবে আমরা জানি না। অনেক পরিবারে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বেড়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। যার বড় একটা অংশের শিকার হচ্ছে শিশু–কিশোরেরা।
তবে আমি বিশেষভাবে ব্যথিত হই কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েগুলোর কথা ভেবে; যারা ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকেই বয়ঃসন্ধিকালের জটিল দিনগুলো অতিবাহিত করছে। বয়ঃসন্ধিকালীন এই শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এই বয়সের শিশুরা এমনিতেই নিজেদের নানা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে বিপর্যস্ত থাকে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কিশোর-কিশোরী এই পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তার ওপর স্কুল বন্ধ থাকায় বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুরা যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করার অনুভূতি নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করার ফলে এই শিশুগুলো তাদের একান্ত সমস্যা, অনুভূতি আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারছে না। ফলে তাদের একাকিত্ব বাড়ছে।
অনেক পরিবার বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়ে উদাসীন। স্কুলে সমবয়সীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হলে কিশোর-কিশোরীরা অন্তত বুঝতে পারে পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় সে একা নয়। সহপাঠীদের শরীর আর মনের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের পরিবর্তনকে মিলিয়ে নিয়ে সে আশ্বস্ত হয়, অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু করোনায় সে পথ রুদ্ধ। আবার এই পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি চাপও আছে। পরিবর্তিত শরীর আর মন নিয়ে এই শিশুগুলো যখন স্কুলে ফিরে যাবে, তখন চেনা বন্ধু আর পরিবেশকেও অচেনা মনে হতে পারে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যও তাদের প্রস্তুত করতে হবে।
বিশ্বে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বাস করে। করোনায় এই ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বয়ঃসন্ধিকালীন জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক–পঞ্চমাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডলেসেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং সার্ভে ২০১৯-২০। ১৫-১৯ বছর বয়সী মোট ১৮ হাজার ২৪৯ জনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যাচ্ছে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি বিষণ্নতায় ভুগছে। সেখানে দেখা যায় ১৫ শতাংশ বিবাহিত কিশোরী, ১১ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী এবং ৫ শতাংশ কিশোর বিষণ্নতায় ভুগছে। করোনায় নিশ্চিতভাবেই এই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
এই সময়ের আরেকটি বাস্তবতা হলো প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা। করোনা পরিস্থিতি একদিকে যেমন শিশুদের বাইরের জগৎকে সীমিত করেছে, অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা তাদের সামনে খুলে দিয়েছে এক অবাধ ভার্চ্যুয়াল পৃথিবী। এই দুই পৃথিবীর সমন্বয় করতে গিয়ে অনেকেই গোলকধাঁধায় পড়ছে। অন্যদিকে তাদের প্রতি পরিবারের প্রয়োজনীয় মনোযোগের অভাব তাদের হতাশায় নিমজ্জিত করছে। ভীষণ অস্থিরতায় ভুগতে থাকা কিশোর–কিশোরীরা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কেউ টিকটক তারকা হওয়ার যুদ্ধে শামিল, কেউবা আবার নিজেই ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফলোয়ার বাড়াতে মশগুল। এই সব ভিডিওর বিষয়বস্তুর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই তো কয়েক দিন আগে মাত্র ১০–১১ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ফেসবুকে লাইভে এসে মেকআপের সেশন নিতে দেখলাম। চট্টগ্রামে ১২ বছর বয়সী এক কিশোরী বাড়ি থেকে পালিয়েছে সিনেমার নায়িকা হওয়ার উদ্দেশ্যে।
এসবই কৈশোর হারানো এক কিশোর প্রজন্মের বাস্তবতা। অপরিণত বয়সে এই ধরনের প্রচেষ্টার আড়ালে থাকে মূলত নিজের প্রতি অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রবণতা। মূলত পরিবার ও কাছের মানুষগুলোর মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া শিশুরাই বিষণ্নতা ও একাকিত্বে ভোগে এবং সেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার কৌশল হিসেবে তারা অন্যের চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
পরিণত হওয়ার আগেই কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েগুলো যেন করুণ পরিণতির দিকে পা না বাড়ায়, সেদিকে আমাদের সবাইকে যত্নবান হতে হবে। অতিরিক্ত শাসন কিংবা অতিরিক্ত স্বাধীনতা—কোনোটাই সমস্যার সমাধান দেবে না। যেসব স্কুল অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে তারা এই বয়সী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন মাথায় রেখে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে কাউন্সেলিং করাতে পারে। এ ছাড়া যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। রেডিও টেলিভিশন, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও এই বিষয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। এ ছাড়া প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ ব্যবহারে তাদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। সর্বোপরি তাদের প্রতি মনোযোগ, ভালোবাসা এবং গুণগত মানসম্পন্ন পারিবারিক সময়দানই পারে বয়ঃসন্ধিকালীন এই প্রজন্মকে স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর ভবিষ্যতের পথ দেখাতে। আসুন, করোনা পরিস্থিতিতে বয়ঃসন্ধিকালীন এই শিশুদের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতি ও আন্তরিক হই।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী