কোভিড-১৯-এর প্রভাবে কমবেশি সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত। সবচেয়ে বড় আঘাতটি লেগেছে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষকদের সরাসরি সান্নিধ্যে থেকে, বন্ধুদের সঙ্গে মতবিনিময় করে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা লাভ করত, প্রায় এক বছর ধরে তা থেকে তারা বঞ্চিত। বিভিন্ন জাতি নানা কৌশলে তরুণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কিছু ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ যা করছে, আর যা করা যেত, তা নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ।
শিক্ষাক্রম পরিমার্জন: চক্ষু মুদিয়া দেখ রূপ রে!
শিক্ষাক্রম উন্নয়নে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত তিনটি সম্পূর্ণ (১৯৭৬ সালে শুরু, ২০১২ সালে শেষ) এবং একটি অসম্পূর্ণ (২০০২-২০০৫ সালে শুধু প্রাথমিক স্তর ও মধ্য-মাধ্যমিক উপস্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন) আবর্তন শেষ করেছে। এসব আবর্তনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল ১০-১৫ বছর। কিন্তু ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ ’-এর মাত্র ৭-৮ বছর পেরোনোর পর ২০১৯-২০ সালে সব স্তরের শিক্ষাক্রম আবার পরিমার্জন করা হচ্ছে। আগেভাগে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের প্রধান উদ্দেশ্য দুটো: ১) জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন এবং ২) বিদ্যালয় শিক্ষায় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের বিশ্বব্যাপী ঢেউকে ধারণ। স্বাধীন দেশে শিক্ষাক্রমের কোনো আবর্তনের বাস্তবায়নই তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। তাই এবার ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন করাও একটি চ্যালেঞ্জ।
করোনা আঘাত হানার আগেই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজ শেষ হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইংয়ের নেতৃত্বে গত দেড় বছরে লেখা হয়েছে শুধু ‘শিক্ষাক্রম-রূপরেখা’ (পূর্ণ শিক্ষাক্রমের ভূমিকা)। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ওই রূপরেখার তিনটি সংস্করণ লেখা হয়। প্রথম দুটিতে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২’ কে কষে গালিগালাজ এবং বর্তমান প্রচেষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রয়াস লক্ষণীয়। তৃতীয় সংস্করণে প্রথমবারের মতো পৃষ্ঠা নম্বর এবং রেফারেন্স যোগ করা হয়েছে। কিন্তু দলিলটিতে ধারণাগত, ভাষাগত এবং ফরম্যাটিং (যেমন, লেখায় তথ্যের উৎস নির্দেশ ও রেফারেন্স) ত্রুটির প্রকার এবং পরিমাণ দেখে প্রস্তুতকারীদের মান নিয়েই প্রশ্ন জাগে।
বোঝা গেল মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম উইং কর্তৃপক্ষ শিক্ষাক্রমে এখনো অ্যামেচার। তাঁর হাতের কাছে সেসিপ প্রকল্পের প্রায় ২০ শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই ২০০৩ সাল থেকে শিক্ষাক্রম উন্নয়নের অভিজ্ঞতা নিয়ে বসে আছেন। কিন্তু তাঁদের পাশ কাটিয়ে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের ব্যর্থ চেষ্টা করা হচ্ছে। দেখে মনে হয়, তাঁরা যেন ‘যত বেশি জানে তত কম মানে’ নীতি অনুসরণ করছেন।
২০১১-১২ সালে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমের জন্য পরামর্শকের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমদ আর মাধ্যমিকের জন্য অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান। এবার প্রাথমিক শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রায় শেষ করার পর অধ্যাপক কফিলউদ্দিনকে ‘শিক্ষা ও দেশের শত্রু’ আখ্যা দিয়ে অপমান করা হয়েছে; অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান পরামর্শকই নিযুক্ত হননি। পরিস্থিতি বুঝে তিনি ‘কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিভিউ কোর কমিটি’র ‘লিড কারিকুলাম স্পেশালিস্ট’ পদ থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। দেশের শিক্ষাক্রম বোদ্ধারা সম্ভবত ‘চক্ষু মুদিয়া’ শিক্ষাক্রম রূপরেখার ‘রূপ’ দেখছেন।
শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া
শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচানোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার ২০২০ সালের মধ্য-মার্চ থেকে সব বিদ্যালয় বন্ধ রেখেছে। বছরের মাঝামাঝি থেকে কিছু অনলাইন ক্লাস চলছে। করোনা সংক্রমণ তেমন না কমায় বিদ্যালয় খোলা হয়নি। অক্টোবর-নভেম্বরে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে, বাড়ির কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। সিলেবাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তৈরি বাড়ির কাজগুলো বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো হয়। এই বাড়ির কাজের মধ্যে ছিল কিছু প্রশ্ন, নির্ধারিত কাজ ইত্যাদি। এই কাজটি আরও আগে করা গেলে পুরো করোনাকালেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ধরে রাখা যেত।
২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে অফিস-আদালত, কলকারখানা, হাটবাজার ও একসময় যানবাহন পুরো মাত্রায় চলা শুরু হয়েছে। বর্তমানে ক্রমহ্রাসমান করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা মনে হয় ঠিক না। জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মার্চের শুরু থেকেই সব বিদ্যালয় খুলে দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে টিকা গ্রহণকারীদের জন্য নির্ধারিত বয়সের বাধা উঠিয়ে দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠানো যেতে পারে।
পাবলিক পরীক্ষা: অটো প্রমোশনের বালাই
শিক্ষার মতো জাতি গঠনের মূল ভিত্তিতে কোনো সহজ উপায় (শর্টকাট মেথড) চলে না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির পর ১৯৭২ সালে লেখাপড়াকে ‘সহজ করে দেওয়ার জন্য’ অটো প্রমোশন দেওয়া হলে আমার পঞ্চম শ্রেণির পড়াশোনা তথা প্রাথমিক শিক্ষা সারা জীবনের জন্য অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯৭২-৭৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় যারা পাস করেছে, তারা সারা জীবন পাসের অশুদ্ধতার জন্য গালি খাচ্ছে।
করোনার কারণে ২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। জানা যায়, বিভিন্ন দেশ এই প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার্থীদের কোর্সওয়ার্কের নম্বরের ভিত্তিতে গ্রেড দিয়ে ফলাফল প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশে কোর্সওয়ার্কের গঠনকালীন নম্বরের তেমন ব্যবস্থা নেই, তবে প্রাক্-নির্বাচনী এবং নির্বাচনী পরীক্ষায় নম্বর আছে। উদ্দেশ্য গোপন করে পরীক্ষা বোর্ডের কাছে এসব নম্বর চাওয়া যেত। এই নম্বরের ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল তৈরি করা যেত। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপকেরা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার্থীদের অর্জনকে অবহেলা করে তিন ও পাঁচ বছর আগের দুটো পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ফলাফল ঘোষণা করেন। যারা হয়তো নির্ঘাত ফেল করত, তাদেরও অনেককে লটে পাস করিয়ে দিলেন।
পড়া হয়নি, এই অজুহাতে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরাও এখন অটোপাসের দাবি তুলছে। করোনার কারণে পুরো বছর লেখাপড়া হয়নি, কোনো ক্লাসের শিক্ষার্থীই তাই অটো প্রমোশনের দাবি করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের সারা জীবনের ভবিষ্যৎ এক বছরের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান! তবে ২০২১ সালে বিদ্যালয় খুললে প্রথম ২-৩ মাস ২০২০-এর জন্য নির্ধারিত সিলেবাস সংক্ষেপে শেষ করে, ২০২১ সালের জন্য নির্ধারিত ওপরের ক্লাসের সিলেবাসে পড়ানোর ব্যবস্থা করে একটা মধ্যপন্থা নেওয়া যায়।
শিক্ষাক্রম পরিমার্জন প্রক্রিয়ার ঘাপলা দূর করে যথাশিগগিরই পরিমার্জন প্রক্রিয়া শেষ করে একদিকে নতুন পাঠ্যপুস্তক রচনা, অন্যদিকে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে আনা পরিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষাক্রম বিস্তার (ডিসেমিনেশন) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের ২০২১ সালেই ভালোভাবে অবহিত করে ২০২২ সাল থেকে শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন ফলপ্রসূ করা যেতে পারে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষাক্রম গবেষক (শিক্ষাবিজ্ঞানে ওভারসিস পিএইচডি) এবং প্রাণিবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
[email protected]