করোনাকালে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যবসায়ী থেকে উদ্যোক্তা, সংবাদমাধ্যম থেকে এনজিও—সবার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এখনো পড়ছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তরুণেরা। এই তরুণদের একাংশ সবে শিক্ষাঙ্গন পেরিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন। অপরাংশ শিক্ষাজীবনের শেষ ধাপে ছিল; যাঁরা স্নাতক সম্মান শেষ বর্ষ বা স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষার্থী ছিলেন। করোনা তাঁদের জীবন থেকে ইতিমধ্যে দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। কবে করোনার অবসান হবে, শিক্ষা ও চাকরির বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে, এখনো নিশ্চিত নয়।
এ অবস্থায় চাকরিপ্রার্থী তরুণেরা যে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন, তা অযৌক্তিক নয়। দেড় বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি খাতে নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সমস্যার দোহাই দিয়ে হয় কর্মী ছাঁটাই করেছে, অথবা তাঁদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশে চাকরির বিজ্ঞপ্তি কমেছে ৭৬ শতাংশ। এই বিজ্ঞপ্তি মানে নতুন চাকরি নয়। কর্মীর অবসরে কিংবা অন্যত্র যাওয়ার কারণে শূন্যস্থান পূরণ।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করার দাবিতে তরুণেরা একটি প্ল্যাটফর্ম করেছেন, যার নাম চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম। এঁদের বেশির ভাগ সম্পূর্ণ বেকার। পড়াশোনার পাট শেষ বলে বাড়ি থেকে টাকাপয়সাও আনতে পারছেন না। আবার করোনার কারণে কোথাও আবেদন করবেন, সেই সুযোগও নেই। অপরাংশ পড়াশোনার শেষ ধাপে আছেন; কিন্তু কবে বকেয়া পরীক্ষা ও ক্লাস হবে, তাঁরা জানেন না। এক অস্থির ও অনিশ্চিত জীবন। নিরুপায় হয়ে এই তরুণেরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন তাঁদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর জন্য। তাঁরা তাঁদের দাবির কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছেন। যদিও জানেন তাঁরা এই খোলা চিঠির জবাব কোনো দিন পাবেন না। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে যেকোনো নাগরিক তাঁর প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলে জবাব পান। যদি সেই চিঠির বক্তব্য তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হয়, জানিয়ে দেন এই কারণে আপনার আবেদন গ্রহণ করা গেল না। এটাই হলো নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ।
চাকরিপ্রত্যাশী প্রজন্মের প্রতিনিধিরা কেবল খোলা চিঠি নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও কয়েকজন সাংসদের সঙ্গে দেখা করে সরাসরি তাঁদের দাবির কথা জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ নেতার কাছেও গিয়েছেন। ব্যক্তিগত আলোচনায় বেশির ভাগ মন্ত্রী-সাংসদ ও নেতা তাঁদের দাবির সঙ্গে একমত হয়েছেন। জাতীয় সংসদের গত অধিবেশনেও কোনো কোনো সাংসদ বিষয়টি তুলেছিলেন।
কিন্তু এরপর সরকারের পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে আদেশ জারি করেছে, তাতে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা হতাশ। তাঁরা চেয়েছিলেন করোনার কারণে নিয়োগ বন্ধ ছিল, কোথাও আবেদন করতে পারেননি; সে জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করা হোক। কিন্তু ১৯ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ২১ মাস ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তা-ও শর্ত সাপেক্ষে। সবাই এ সুযোগ পাবেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, ‘যেসব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও তার অধীন অধিদপ্তর, দপ্তর এবং সংবিধিবদ্ধ, স্বায়ত্তশাসিত বা জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠান কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি চাকরিতে (বিসিএস ছাড়া) সরাসরি নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেনি, সেসব প্রতিষ্ঠানকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিতব্য বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের বয়সসীমা গত বছরের ২৫ মার্চ নির্ধারণ করতে হবে।’ গত বছর সাধারণ ছুটিতে ক্ষতিগ্রস্ত চাকরিপ্রার্থীদের পাঁচ মাস ছাড় দিয়েছিল সরকার। তরুণবান্ধব সরকারের ‘অনুদার ছাড়’।
করোনা ৩০ বছর পার করা তরুণদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাঁদের চেয়ে কম বয়সীদেরও। যে ছেলে বা মেয়েরা দেড় বছর ধরে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিতে পারলেন না, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত। করোনার শুরুতে যাঁদের বয়স ২৬ ছিল, তাঁরা এখন ২৮ বছর, যাঁদের বয়স ২৭ বছর ছিল, তাঁরা ২৯-এ পড়েছেন। অথচ তাঁদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়নি।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ যাঁদের বয়স ৩০ বছর ছিল, তাঁরা চলতি বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরির আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু বিসিএস পরীক্ষার্থীরা সে সময় পাবেন না। তাঁদের আগের নিয়ম মেনে আবেদন করতে হবে। অর্থাৎ যাঁদের বয়স ২০২০ সালের ২৫ মার্চ ৩০ বছর ছিল, শুধু তাঁরা সুযোগ পাবেন। স্বাভাবিক সময়ে ইতিমধ্যে দুটি বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল বের হওয়ার কথা। একটিও বের হয়নি। তাহলে বিসিএস পরীক্ষার্থীরা বয়স ছাড়ের সুবিধা পাবেন না কেন? গত দেড় বছরে যাঁরা স্নাতক সম্মান শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন, তাঁরাই-বা কী দোষ করেছেন? করোনা না থাকলে তাঁদের কেউ পরীক্ষা দিয়ে হয় চাকরিজীবনে ঢুকতেন, কেউ স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে উন্নীত হতেন। তাঁদের জীবন থেকেও দেড়-দুই বছর হারিয়ে গেল।
চাকরিপ্রত্যাশী প্রজন্মের তরুণেরা কেবল মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদদের কাছে ধরনা দেননি। তাঁরা গত ৬ মে ও ২৭ জুন করোনাঝুঁকি নিয়ে ঢাকার শাহবাগে মানববন্ধন করেছেন। ১১ জুন সেখানে সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন। ৩ জুন জাতীয় সংসদের সামনে মৌন সমাবেশ করেছেন। ১২ এপ্রিল, ৬ জুন ও ১২ জুন তিন দফা সংবাদ সম্মেলন করে সরকার ও দেশবাসীর কাছে তাঁদের দাবির কথা জানিয়েছেন।
এই তরুণদের ভাষ্য হলো, ১৯ আগস্ট সরকার যেই ‘ভূতাপেক্ষ’ পদ্ধতিতে চাকরির আবেদন করার বয়সসীমা বাড়িয়েছে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিংবা পাঠ শেষ করা সব তরুণের জীবন থেকে দেড়-দুই বছর হারিয়ে গেছে। অতএব তাঁদের সবাইকে সেই সুযোগ দিতে হবে। দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, এই যুক্তিতে আগে চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ২৩-২৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হয় বলে সরকার যে যুক্তি দেখাচ্ছে, তা-ও সঠিক নয় বলে দাবি তরুণদের। সেশনজট আগের তুলনায় কমলেও এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো শিক্ষার্থীর বের হতে ২৬-২৭ বছর লেগে যায়। এরপর চাকরির জন্য ধরনা দিতে দিতে তাঁদের জুতার সুকতলি ক্ষয় করতে হয়।
এ অবস্থায় চাকরিপ্রত্যাশীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যাকডেট দেওয়া কিংবা বয়স সমন্বয়ের মাধ্যমে সব বয়সী শিক্ষার্থীর ও চাকরিপ্রত্যাশীদের সমস্যার সমাধান হবে না। করোনা ৩০ বছর পার করা তরুণদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাঁদের চেয়ে কম বয়সীদেরও। যে ছেলে বা মেয়েরা দেড় বছর ধরে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিতে পারলেন না, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত। করোনার শুরুতে যাঁদের বয়স ২৬ ছিল, তাঁরা এখন ২৮ বছর, যাঁদের বয়স ২৭ বছর ছিল, তাঁরা ২৯-এ পড়েছেন। অথচ তাঁদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়নি। তাই ২১ মাস ছাড় দিয়ে নয়, সবার জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়াতে হবে।
প্রতিবছর কর্মবাজারে ২১–২২ লাখ তরুণ প্রবেশ করেন। সরকারের হাতে এত চাকরি নেই যে বিপুলসংখ্যক তরুণের চাহিদা মেটাবে। ফলে বেসরকারি খাত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কাজের চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু বেসরকারি খাতও সরকারি চাকরিবিধির বয়সসীমা অনুসরণ করে। সেখানেও ব্যতিক্রম ছাড়া ৩০ বছর বয়সের বেশি কাউকে নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সরকারি চাকরি পান মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, বেসরকারি চাকরি পান ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যক্তিমালিকানাধীন ও অন্যান্য খাত যথাক্রমে ৬০ দশমিক ৯ ও ২১ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে করোনাকালে তরুণদের জীবন থেকে যে সময়টি হারিয়ে গেছে, তা পূরণ করা না হলে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আর তরুণদের ভবিষ্যৎ না থাকা মানে বাংলাদেশেরও ভবিষ্যৎ না থাকা।
করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু এই তরুণেরা কোনো আর্থিক প্রণোদনা চান না। চান জীবন থেকে যে দুটি বছর হারিয়ে গেছে, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একটা সুযোগ করে দেওয়া হোক। চাকরির বয়সসীমা ৩২ করলে সরকারের আর্থিকভাবে এক পয়সাও ক্ষতি হবে না; কিন্তু বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশী চোখে আশার আলো দেখবেন।
তরুণদের প্রতি সরকারের আরেকটু উদার হওয়া উচিত।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি