কংগ্রেস নভোমণ্ডলের নতুন নক্ষত্র রাহুল গান্ধী। মা সোনিয়া গান্ধী দলের নেতৃত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি এখন দলের সভাপতি। জওহরলাল নেহরুর নাতির ছেলে রাহুল। তার মানে, যদি দল আবার ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নেহরু বংশের জন্যই সংরক্ষিত থাকল। ৪৮ বছর বয়সী রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের এযাবৎকালের সবচেয়ে কম বয়সী সভাপতি। দেশ যেসব সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে, তার সমাধান তাঁর কাছে আছে কি না, তা দেখার বিষয়। তাঁকে অবশ্য স্থূলবুদ্ধির কাঠখোট্টা মানুষ হিসেবে মনে করা হয়। তিনি জনগণকে বিভক্ত করার জন্য ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং এর আদর্শিক সংগঠন আরএসএসকে সঠিকভাবেই আক্রমণ করেছেন। বিশেষ করে দুর্নীতি ইস্যু সামনে এনে রাহুল নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন।
অবশ্য ইরাকে ৩৯ জন ভারতীয় হত্যার বিষয় নিয়ে বিরোধী দলগুলো একসঙ্গে সরকারকে যেভাবে আক্রমণ করেছে, সেটা ঠিক হয়নি। চার বছর আগে এই লোকগুলো অপহৃত হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ অপহৃত ভারতীয়দের মুক্তির জন্য পশ্চিমাদের চাপ দিতে পারতেন। এ বিষয়ে পশ্চিমাদের আচরণ বোধগম্য নয়। তাদের কেউ এই গণহত্যায় শোক প্রকাশ করেনি।
এদিকে কংগ্রেস এই গণহত্যার জন্য বিজেপিকে এককভাবে দায়ী করে যাচ্ছে। অপহৃতদের হত্যার খবর দেরি করে ঘোষণা করার জন্য তারা সরকারকে দোষ দিচ্ছে। কংগ্রেস নেতা শশী থারুর অপহৃত লোকগুলোর স্বজনদের ‘মিথ্যা আশা’ দেওয়ার জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি প্রত্যেক ভারতীয়র জন্য বেদনাজনক। আমি শুধু বলতে চাই, কেন এই তথ্য দিতে এত দেরি হলো? সরকারের দ্রুত জানানো উচিত কেন এবং কখন তাঁরা মারা গেছেন। সরকার নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে আশায় রেখে ঠিক কাজ করেনি।’
অন্যদিকে, পার্লামেন্টের অবস্থানও ছিল অতিমাত্রায় গতানুগতিক। এই গণহত্যা নিয়ে পার্লামেন্টে যে বিতর্ক হয়, তাতে কংগ্রেস ও বিজেপির বিভক্তি প্রতিফলিত হয়েছে। দলাদলির বাইরে এসে তাদের এই গণহত্যার বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করা উচিত ছিল। মৃত্যুর বিষয়টি সম্পর্কে সরকার আগে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল বলে সুষমা স্বরাজ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা বিলম্বিত তথ্যদানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে তাঁর সরকারের নেওয়া ব্যবস্থার কথা বলার দরকার ছিল।
সুষমার এই বক্তব্য ঠিক যে সরকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো ঘোষণা দিতে পারে না। সুষমা বলেছেন, ‘নিশ্চিত হওয়ার আগেই কাউকে মৃত ঘোষণা করা কোনো দায়িত্বশীল সরকারের কাজ হতে পারে না।’ আমি মনে করি, কংগ্রেসে রাহুল গান্ধীর একটি নতুন অধ্যায় উন্মোচন করা উচিত। ইরাকে ভারতীয়দের হত্যার খবর ঘোষণা করতে সরকারের বিলম্ব নিয়ে সমালোচনা করার জন্য একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। এ বিষয়ে সরকার এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই গণহত্যায় নিন্দা জানানোর জন্য মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের এক প্ল্যাটফর্মে জড়ো করা যেত। এ বিষয়ে নিন্দা জানানোর জন্য আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে সংহতি প্রকাশে এগিয়ে আসতে বলতে পারতাম। কিন্তু সরকার সেসব কিছুই করেনি।
ইত্যবসরে সব বিরোধী নেতাকে নিয়ে সোনিয়া গান্ধী নৈশভোজ করেছেন। তিনি বিজেপির বাইরের সব দলকে এক জায়গায় আনতে পেরেছেন এবং তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, ২০১৯ সালে বিজেপিকে আর ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না। কংগ্রেসের মুখ্য মুখপাত্র সূর্যেওয়ালা বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে সোনিয়া নৈশভোজের আয়োজন করেননি। কেবল বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় করতেই ওই আয়োজন করা হয়েছিল।
সূর্যেওয়ালা এমন সময় কথাগুলো বলছিলেন, যখন কংগ্রেস পার্লামেন্টে যোগদান থেকে বিরত থেকে পার্লামেন্টকে কার্যকর হতে দিচ্ছিল না। এটা নিশ্চিত যে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই বিভিন্ন দলের নেতারা ওই নৈশভোজে গিয়েছিলেন। সোনিয়া গান্ধী বরাবরই বিরোধী জোটকে আরও বড় করার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। বিজেপি যাতে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য বিরোধী সব দলকে বিভেদ ভুলে একাত্ম হতে বলছেন। সোনিয়া গান্ধী সরাসরি নাম ধরে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদিকে কিছুতেই আর ক্ষমতায় বসতে দেওয়া যাবে না। এসব দেখে মনে হচ্ছে, বিজেপিকে ফেলে দেওয়ার জন্য সব দল একজোট হতে শুরু করেছে। সিপিআইএমের মোহাম্মাদ সেলিম বলেন, আরও বড় পরিসরে শিগগিরই এ ধরনের বৈঠক হবে। এ মাসের শেষে শারোদ পাওয়ার বিরোধীদের নিয়ে বৈঠক করবেন বলে জানিয়েছেন। সোনিয়ার নৈশভোজের পর বিজেপির সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অনন্ত কুমার পাল্টা আক্রমণ করে বলেছেন, ‘সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা পার্লামেন্টে না এসে বাইরে গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলছেন। কংগ্রেসের জিনে গণতন্ত্র নেই।’
পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে রাহুল বিজেপিকে আক্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তিনি অভিযোগ করেছেন, মোদি সরকার ভারতের বড় শিল্পপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। রাহুল বলেন, বিজেপির বক্তব্যে একটি সুনির্দিষ্ট দলের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আর কংগ্রেসের বক্তব্যে গোটা দেশের কথা উঠে আসছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, মনমোহন সরকার তাদের ক্ষমতার শেষ দিকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষ। আমাদের ভুল হতে পারে। কিন্তু মোদি নিজেকে মানুষ ভাবেন না। তিনি নিজেকে অবতার মনে করেন।’ রাহুল বলেন, কংগ্রেস দেশকে এগিয়ে নেবে। কংগ্রেস তরুণদের দল।
রাহুল তাঁর দলের আবর্জনা কীভাবে এবং কতখানি সাফ করতে পারবেন, সেটা দেখার বিষয়। দেশের জনগণ তাঁর দিকে চেয়ে আছে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো কর্মসংস্থান। জনগণের মনে প্রশ্ন, তিনি কি বছরে নতুন দুই লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবেন? এই অর্থনীতিকে চাঙা করে প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশে নিতে পারবেন?
কুলদীপ নায়ার ভারতীয় সাংবাদিক ও কলামিস্ট