ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর
যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্ট বেটাই চোর’!
৫ আগস্ট ২০১৬ প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় পাতায় আমার পছন্দের মানুষ ও লেখক আনিসুল হক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে গদ্যকার্টুন ফেঁদেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে মানতেই হলো যে ওপরের কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশ্চয়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েই লিখেছিলেন! এর আগের দিন দেশের প্রবীণ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে মাদ্রাসার সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ, তাঁর মতে, দুটোর কোনোটাতেই মাতৃভাষার চর্চা সেভাবে নেই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পেশ করার আগে একটা নোক্তা দিয়ে রাখতে চাই: যাঁরা কথায়-কথায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা সমরূপী বর্গ হিসেবে উল্লেখ করেন, তাঁদের বক্তব্য প্রায়ই শিশুসুলভ ও সাম্প্রদায়িক শোনায়। বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সরকারি’ ও ‘বেসরকারি’ এই দুই ভাগে ভাগ করা হয় প্রশাসনিক সুবিধার জন্য। কিন্তু সেই বিভক্তির হ্যাংওভার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অন্তত কাটাতে পারা উচিত বলে আমি মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। সে তার শিক্ষাক্রম পাঠদানের কৌশল স্বাধীনভাবে তৈরি করতে সক্ষম। ফলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বিশিষ্ট চরিত্র থাকে বা অর্জিত হয়। পৃথিবীর কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম সরকারি-বেসরকারি বর্গবিভাজন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় করা হয় বলে শুনিনি।
আনিসুল হকের লেখাটি রসরচনা। ফলে সিরিয়াসলি নেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু মশকরারও রাজনৈতিক চরিত্র থাকে বা মশকরায় ভিন্ন অর্থ তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন ‘যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, কেষ্ট বেটাই চোর’। আমি তাঁর লেখার গুণগ্রাহী, ফলে আরেকটু অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মশকরা আশা করেছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠানে এ রকম ঘটনা যে ঘটছে না, আমি সেটা বলছি না। কিন্তু সেটা সরকারি-বেসরকারিনির্বিশেষে। কোথাও টাকার বিনিময়ে, কোথাওবা অন্য কিছুর বিনিময়ে। সেই বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্তকে জেনেরালাইজ করা খুবই অন্যায়, সরকারি কিংবা বেসরকারি যেকোনো নামেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুটো দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছি। এর একটি সরকারি, অন্যটি বেসরকারি। আমি আমার দুই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই গর্বিত। একটিতে আমি উদার প্রান্তর উপভোগ করেছি, অন্যটিতে সংকীর্ণ শ্রেণিক। কিন্তু সেই স্থানিক সংকীর্ণতা আমাকে মানসিকভাবে সংকীর্ণ করে ফেলেছে, এমন প্রমাণ আমি পাইনি। আর যদি আমাকে আমার তুলনামূলক প্রাপ্তির বিচার করতে বলেন, তবে আপনি কিন্তু হতাশ হবেন!
উদার প্রান্তর থাকলেই দৃষ্টিভঙ্গি উদার হয়ে উঠবে, এমন কিন্তু সব সময় নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার প্রার্থীর থেকে অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি কি উৎপন্ন হচ্ছে না? আবার, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গি উৎপন্ন হচ্ছে, এমন বক্তব্য দেওয়ার আগে আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি কীভাবে যুগের পর যুগ উদার প্রান্তরসমৃদ্ধ চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মৌলবাদী রাজনীতির সূতিকাগার হয়ে বিরাজ করত? কিন্তু সেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে বা তাদের শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে আমরা কি কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করেছি?
আনিসুল হক যেখানে কৌতুকপ্রবণ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেখানে সিরিয়াস! তিনি বলছেন, মাদ্রাসা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারাক নাই, যেহেতু দুটোর কোনোটাতেই সেভাবে মাতৃভাষার চর্চা নাই (প্রথম আলো, ৫ আগস্ট ২০১৬)। ঠিক কোনভাবে মাতৃভাষার চর্চা এই প্রবীণ বুদ্ধিজীবী আশা করছেন তা অবশ্য পত্রিকায় উদ্ধৃত তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়নি। আমি যে ‘বেসরকারি’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেখানে বাংলা ভাষার ওপর সবার জন্য (পঠিত বিষয়নির্বিশেষে) একটা আবশ্যিক কোর্স আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপরও একটা আবশ্যিক কোর্স আছে, যা সবাইকে পড়তে হয়। তদুপরি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা করার জন্য একটা ডেডিকেটেড গবেষণাকেন্দ্রও আছে। এখানেই শেষ নয়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হয়তো এটাও জানেন না যে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও বাংলা সমান্তরালভাবেই ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে জনাব চৌধুরীর বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে একটা অনিবার্য বাস্তবতা ছিল, যে কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীর শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ নিচ্ছেন। তঁাদের একটা বড় অংশই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থী। তাঁদের একটা মানসম্পন্ন স্নাতকে পরিণত করতে গিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে যে হয়, এটা মনে হয় আমাদের অনেকের হিসাবের মধ্যেই নেই। সমসাময়িক বাংলাদেশের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি চোখে না পড়ে উপায় নেই। ভ্যাটের বিরুদ্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ধারার আন্দোলন করে সাফল্য এনেছেন, তা ছাত্ররাজনীতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবু আমরা ঠুলি পরেই বসে থাকব বলে যেন মনস্থ করেছি! যেমন আনিসুল হক ভাবছেন, পাঁচ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠেঘাটে ঘোরাঘুরি করলেই সে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্টক্লাস পাওয়া ছাত্র থেকে উৎকৃষ্ট মানুষ হয়ে উঠবে! যেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সারা দিন ক্লাসরুমেই বসে থাকেন। হাটে-মাঠে-মলে-দোকানে ঘোরাঘুরি করেন না!
তবে আমি মনে করি, আপনার মায়ের তিন কাঠা জমির ওপর বানানো বাড়িটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো ঠিক হবে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ রকম জায়গায় আর বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অনুমোদন দেবে না। যদি দেয়ও, তবে আপনাকে একটা মানসম্মত ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেবে। যেতে না পারলে আপনার লাইসেন্স বাতিল করে দেবে। সে ক্ষেত্রে আপনার মায়ের জমিটাও সরকার ক্রোক করে নিতে পারে। ফলে আম ও ছালা উভয়ই হারানোর আশঙ্কা আছে! বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এখন এ রকম তোপের মুখে আছে।
আপনি একটি দায়িত্বশীল দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আপনার মতো অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি আছেন, যাঁরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষা বিস্তারের কাজ করেন। আর জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান উৎপাদনেও এসব বিশ্ববিদ্যালয় উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে। সব সংবাদপত্র যেমন এক কাতারের নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ও নয়। এ ধরনের নির্বিচার বর্গীকরণ করলে ভালো প্রচেষ্টাগুলো নিরুৎসাহিত হয়।
সুমন রহমান: কবি, গল্পকার। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এর শিক্ষক।