এই সর্বনাশা প্রবণতা বন্ধ করতেই হবে

নির্বাচনগুলো এখন ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

একই ধরনের অনৈতিক ও আইনবহির্ভূত কাজ যদি বারবার হতে থাকে, তখন তা সহনীয় হয়ে যায়। জনগণ তা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না। সে ব্যাপারে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়াও থাকে না। যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পালিত হচ্ছে ধর্মীয় আচারের মতো, আনুষ্ঠানিকতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকছে অপূর্ণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট এলাকার ভোটাররা তাঁদের একজন প্রতিনিধি বেছে নেবেন একাধিক প্রার্থীর ভেতর থেকে। নির্বাচনে বিজয় এবং পরাজয় খুব স্বাভাবিক ব্যাপার—কম ভোটারের সমর্থন পাওয়া কিছুমাত্র অমর্যাদা বা লজ্জার বিষয় নয়।

গত পাঁচ সপ্তাহে পৌরসভার তিন ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হলো। প্রথম ধাপের তফসিলের ২৪টি পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে ২৮ ডিসেম্বর। সেগুলোতে ভোট হয়েছে ইভিএমে। দ্বিতীয় ধাপের ৬১ পৌরসভায় ভোট হয়েছে ১৬ জানুয়ারি। তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি ৬৪টি পৌরসভায় ভোট হলো। এরপর চতুর্থ ধাপে ৫৮ পৌরসভায় ভোট হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হয়ে গেল। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় পৌরসভাগুলোর নির্বাচনে ভোট পড়েছে বেশি।

কোনো নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীরা কম ভোট পেলে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেই সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে—এই ধারণার পেছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই। কে বিজয়ী হলেন আর কে পরাজিত হলেন, তার সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীর কাছে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীর পরাজিত হওয়ার মধ্যেও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। মূল বিষয় হলো, ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটটি দিতে পেরেছেন কি না, ভোট গণনা নির্ভুল হয়েছে কি না। তারপর নির্বাচন কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণায় অনিচ্ছাকৃত অথবা ইচ্ছাকৃত ভুল করেছেন কি না। ফলাফল ঘোষণায় ইচ্ছাকৃত ভুল করা গর্হিত অপরাধ, অনিচ্ছাকৃত ভুল সংশোধনযোগ্য।

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা কোনো হাতি-ঘোড়া ব্যাপার নয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ও কর্মকর্তাদের আনুকূল্যে পরিকল্পিত বা পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন লোকজনের প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে সে ধরনের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির অভাব নেই। তাঁরা অবলীলায় পরাজিতকে বিপুল ভোটে বিজয়ী এবং বিজয়ীকে গোহারা হারিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। চুপেচাপে দু-চারটি ভুয়া ভোট নির্বাচনে আগেও পড়ত। আক্কেল আলির ভোট সাবেদ আলি মাথা-মুখ মাফলারে ঢেকে দিয়ে আসত।

তাতে নির্বাচনের ফলাফলে কোনো প্রভাব পড়ত না। এখন কারচুপির অনেক রকম পদ্ধতি তৈরি হয়েছে। কোনো পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক, কোনোটি সন্ত্রাসমূলক এবং সেসবই কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অলিখিত অনুমোদিত। এই কাজ যাঁরা করেন, দক্ষতার সঙ্গে তাঁরা এখন একটা পেশাজীবীতে পরিণত হয়েছেন। বেদনার ব্যাপার হলো, এককালে ধাউড় বাটপার শ্রেণির অশিক্ষিত মানুষ যা করত, এখন অনেক উচ্চশিক্ষিত লোক তা-ই করে। কারও মানিব্যাগ থেকে টাকা কিংবা ঘড়ি-আংটি চুরি করা আর কারও ভোট চুরি করা সমান অপরাধ। জোর করে ব্যালট পেপারের বান্ডিল এবং ব্যালট বাক্সটাই ভোটকেন্দ্র থেকে সরিয়ে নেওয়া তো স্রেফ ডাকাতি।

সুষ্ঠু নির্বাচন মানে একই আসনে প্রতিবারই নতুন লোকের বিজয়ী হওয়া নয়। অতীতে দেখা গেছে, একই আসনে কেউ ৩০-৩৫ বছর বারবার নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিবারই তাঁর সঙ্গে কেউ না কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছেন। আবার এমন ব্যক্তিকেও দেখা গেছে, যিনি সারা জীবন নির্বাচনে দাঁড়িয়ে শুধু হেরেইছেন। কিন্তু অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি। নির্বাচন জিনিসটি কোনো জীবন-মরণ সমস্যা নয় যে ভোটে দাঁড়ালেই বিজয়ী হতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীর পরাজয় দলের বা সরকারের পরাজয় নয়।

তিন ধাপে পৌরসভার এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের যে ফলাফল, তাতে যদি ধরে নিই সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অবাধ, কারচুপিমুক্ত নির্বাচন হলেও তাঁরাই জয়লাভ করতেন, তাহলেও প্রশ্ন থাকে। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতে নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম ও কারচুপির যে সচিত্র প্রতিবেদন হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশন আমলে না নেওয়ায় সাধারণ মানুষের এ ধারণা বদ্ধমূল হতেই পারে, এই সব অপকর্মে বা অপরাধমূলক কাজে তাদের নীরব সমর্থন রয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলতে পারেন, কারও কোনো অভিযোগ থাকলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে নালিশ করো গিয়ে। ট্রাইব্যুনালে গেলেই কি ভুক্তভোগীর সমস্যার সমাধান হবে? গত সংসদ নির্বাচনের পর ৫০-৬০টি মামলা হয়েছিল ট্রাইব্যুনালে, তাতে ফরিয়াদির কিছুমাত্র উপকার হয়েছে? আসামিরা বুক ফুলিয়ে স্বপদে বহাল রয়েছেন।

সংক্ষুব্ধ মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে? সর্বোচ্চ পদে থাকলে সাংবিধানিক দায়িত্বের বাইরে নৈতিক দায়িত্ব থাকে। বিবেকের নির্দেশ আরও বড়। টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির প্রতিবাদে মাওলানা ভাসানীর মেয়ে মাহমুদা খাতুন ভাসানী রোববার থেকে শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘট করছেন। ‘কারচুপির আশঙ্কায় তিনি সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। সিইসি তাঁকে সাক্ষাৎ দেননি’ [প্রথম আলো]। ভাসানীর মেয়েকে হুদা সাহেব দেখা দেননি, তাতে শুধু ভাসানীর আত্মা নয়, বঙ্গবন্ধুর আত্মাও সম্ভবত কষ্ট পেয়েছে।

কখনো কারও কারও অনেক কথা অপ্রীতিকর বা বিব্রতকর মনে হতে পারে, কিন্তু ফেলে দেওয়া যায় না। বসুরহাট পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র আবদুল কাদের মির্জা শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ভোট কি ঠিক হয়েছে? ভোট চুরি হয়নি? ২২ শতাংশ ভোটও চুরি করে দিয়েছে। আমরা এই ভোট চাই না।’ শুধু তিনি নন, আওয়ামী লীগেরও যাঁরা রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁরাও চান না। সরকারি কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশও চায় না।

নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বেপরোয়া হঠকারিতায় সরকারি দলের কিছু লোক উপকৃত হলেও দেশের প্রধান দলটির সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হচ্ছে, দেশেরও হবে দীর্ঘস্থায়ী অমঙ্গল। এই সর্বনাশা প্রবণতা ঠেকাতে বড় দল, ছোট দল, সরকারি দল, বিরোধী দল—সব দলের নেতারা যদি সংকীর্ণ মতপার্থক্য ভুলে শক্ত ব্যবস্থা এখনই না নেন, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।


সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক